(অ)সাধারণ আপেক্ষকতা তত্ত্ব
১৯০৭ সাল। পদার্থবিজ্ঞানের জগতে হইচই পড়ে যায় এই বছরে। কারণ এই বছরে পদার্থবিজ্ঞান জগতে যোগ দেয় "সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব"। তত্ত্বের জনক হলেন ২৮ বছর বয়সী তরুণ আলবার্ট আইনস্টাইন, যিনি "বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব" দিয়ে পুরো পদার্থবিজ্ঞানের জগৎকে এলোমেলো করে দিয়েছিলেন ১৯০৫ সালে, যখন তার বয়স ছিল মাত্র ২৬ বছর। নামের শুরুতে "সাধারণ" কথাটি থাকলেও এই তত্ত্বের অসাধারণত্ব বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না।
এই তত্ত্বটি আমাদের মহাকর্ষ বলের প্রকৃত প্রকৃতির ব্যাপারে বলে। মহাকর্ষ বলের ধারণাটি নতুন নয়। মহামতি নিউটন মহাকর্ষ বল নিয়ে যথেষ্ট কাজ করেছেন। কিন্তু তিনি বলেননি মহাকর্ষ বল কাজ করে কীভাবে। অর্থাৎ এই যে বিশাল মহাবিশ্বে এক বস্তু আরেক বস্তুকে টানে, এইটা কেন টানে, কীভাবে টানে। আইনস্টাইনের এই "সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব" ব্যাখ্যা করে এই মহাবিশ্বের এক বস্তু আরেক বস্তুকে কেন টানে, কীভাবে টানে। এই তত্ত্বের এইটাই সবথেকে চমৎকার দিক।
আইনস্টাইনের তত্ত্ব অনুযায়ী এই মহাবিশ্বের সকল বস্তুকে একটি চার মাত্রার স্থানকালের চাদর ঢেকে রেখেছে। এবং এই চার মাত্রার স্থানকালের বক্রতার কারণেই মহাকর্ষ বল তৈরি হয়। দাড়ান! দাড়ান! আগেই ঘাবরে যাবেন না। আমি সব ব্যাখ্যা করছি।
আপনি একটা চাদর নিন। এই চাদরের চারটি প্রান্ত চারজন মানুষকে দিয়ে ধরিয়ে দিন। এখন সেই চাদরের মাঝামাঝি একটি টেনিস বল রাখুন। খেঁয়াল করুন, চাদরটা বলের চারপাশে বেঁকে গিয়েছে। এখন একটি পিংপং বল নিন এবং সেটি চাদরের যেকোনো এক প্রান্তে রাখুন। আপনি দেখবেন, পিংপং বলটি টুপ করে টেনিস বলের কাছে চলে যাচ্ছে। এখন ধরে নেন, এই চাদর অদৃশ্য, দেখা যায় না, তাহলে আপনি কী দেখবেন?
চাদরটি যদি অদৃশ্য হয় তবে আপনি দেখবেন কোনো ভূতুড়ে কারণে পিংপং বলটি টুপ করে চলে যাচ্ছে টেনিস বলের কাছে, যেন অদৃশ্য কোনো শক্তি দিয়ে টেনিস বল আকর্ষণ করছে ছোট পিংপং বলকে। কিন্তু আপনি জানেন কোনো অদৃশ্য শক্তি না, পিংপং বলটি টেনিস বলের কাছে যাচ্ছে চাদরটির জন্য। আরো নির্দিষ্টভাবে বলতে হলে, চাদরের বক্রতার জন্য যা টেনিস বল তৈরি করেছে!
আবার দেখেন, যদি আপনি পিংপং এর জায়গায় কোনো লোহার বল রাখতেন, তবে উল্টা টেনিস বলই সেই লোহার বলের কাছে যেত। কারণ সেই লোহার বল চাদরটিকে টেনিস বলের থেকেও বেশি বাকিয়ে ফেলছে। মোটকথা, দেখতে পাচ্ছি, একটি বল আরেকটি বলের কাছে যাচ্ছে চাদরের বক্রতার জন্য এবং যে বল চাদরের সারফেস যতবেশি বাঁকা করতে পারছে , সে ততবেশি কাছে আনতে পারছে। মূলত কেউ কাউকে "টানছে" না, বরঞ্চ সেই চাদরের বক্রতাই, যা বড়ো বস্তুর কারণে সৃষ্টি হয়েছে, তা ক্রমাগত ছোট বস্তুকে "ঠেলে" বড়ো বস্তুর কাছে আনছে। "সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব" এর মূলভাব এইটাই।
আমাদের এই মহাবিশ্ব পুরোটাই একটি চাদরের উপর আছে। অর্থাৎ, এই গ্রহ, নক্ষত্র, গ্যালাক্সি, এই সবকিছুই একটি চাদরের উপর আছে, আরো স্পষ্ট করে বলতে হলে বলবো, চার মাত্রার একটি চাদরের উপর। এই চার মাত্রার চাদরকেই আমরা বলছি "চার মাত্রার স্থানকাল"। ইংরেজিতে যাকে বলে "Four Dimensional Space-time"। আমাদের গ্রহ, নক্ষত্র সবকিছুই এই অদৃশ্য চাদরকে বাঁকিয়ে ফেলছে। ফলে দেখা যাচ্ছে, যে বস্তু যত বেশি ওই অদৃশ্য চাদরকে বাঁকাতে পারছে, সে-ই তত বেশি অন্য বস্তুকে কাছে টানতে পারছে, অর্থাৎ তার "মহাকর্ষ বল" তত বেশি! এইযে আমাদের পৃথিবী সূর্যকে ঘিরে ঘুরছে, আবার চাঁদ ঘুরছে পৃথিবীকে ঘিরে, তার সব কারণ আশা করি ধরতে পারছেন। সূর্য সব থেকে বড়ো, তাই সে স্থানকালের এই চাদরকে বড়ো বেশি বাঁকিয়ে ফেলেছে, তার থেকে কম বাঁকিয়ে ফেলেছে পৃথিবী তাই পৃথিবী ঘুরছে সূর্যকে ঘিরে, আবার চাঁদ আরো কম বাঁকিয়ে ফেলেছে, তাই চাঁদ ঘুরছে পৃথিবী ঘিরে।
চিত্র - ১: পৃথিবীর কারণে স্থানকালের বেঁকে যাওয়া।
আমরা যদি এতক্ষণ কি বলা হলো তা বুঝে থাকি, তবে ধরতে পেরেছি মহাকর্ষ বলে কী। মহাকর্ষ বল হলো চার মাত্রার এই চাদরের বক্রতা, আর কিছুই না! অর্থাৎ, এইযে আমরা লাফ মারলে উপরে উঠে আবার নিচে নেমে যাই, এর কারণ এটি নয় যে পৃথিবী আমাদের টানছে, বরঞ্চ আমরা নিচে নেমে যাচ্ছি কারণ স্থানকালের বক্রতা (যা পৃথিবী তৈরি করেছে) ক্রমশ আমাদের নিচের দিকে ঠেলছে!
আইনস্টাইনের এই তত্ত্বটি যথেষ্ট কৌতূহল উদ্দীপক। বড়ো বড়ো বিজ্ঞানীরা ধরতে পেরেছিলেন যে এইটা ঠিক হতেই হবে। কিন্তু বিজ্ঞান এইভাবে কাজ করে না, মানে বড়ো কোনো একজন বিজ্ঞানী বললো বলেই সেইটা হুট করে বিশ্বাস করে ফেলা হলো। বিজ্ঞান পর্যবেক্ষণ এবং পরীক্ষার উপর নির্ভরশীল। কিন্তু এই তত্ত্বের পরীক্ষা কীভাবে করা যাবে?
আমরা কোনো কিছু দেখি কারণ সেই বস্তু থেকে আলো আমাদের চোখে আসে, হয় সরাসরি (যেমন, সূর্য) নাহয় প্রতিফলিত হয়ে (যেমন, চাঁদ)। আলোর চলাচলের জন্য কোনো মাধ্যম লাগে না। আলো স্থানকালের মধ্য দিয়ে খুব সহজেই আসতে পারে। সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব থেকে বিজ্ঞানীরা একটা জিনিস জানেন যে, মহাজাগতিক সকল বস্তুই তার আশেপাশের স্থানকাল বাঁকিয়ে ফেলে। ফলে বাঁকানো স্থানকাল দিয়ে চলার সময় আলোকেও একটি বাঁকা পথে আসতে হবে, অর্থাৎ আলো বেঁকে যাবে! এখন ধরেন, মহাজগতিক কোনো বস্তুর ঠিক পিছনে কোনো বস্তু আছে। যেহেতু দ্বিতীয় বস্তু প্রথম বস্তুর ঠিক পিছনে আছে, আমাদের সেটি দেখতে পাওয়ার কথা না। কারণ দ্বিতীয় বস্তু থেকে আলো প্রথম বস্তুতে দিয়ে ধাক্কা খাবে, আমাদের চোখ পর্যন্ত আসতে পারবে না। ফলে দ্বিতীয়ত বস্তু আমরা দেখতে পারবো না। কিন্তু আমরা জানি মহাজাগতিক বস্তু তার চারপাশের স্থানকালের চাদর বাঁকিয়ে ফেলে এবং যদি আলো সেই বাঁকানো জায়গা দিয়ে অতিক্রম করে তবে আলোও বেঁকে যাবে, অর্থাৎ দ্বিতীয় বস্তু থেকে আলো সরাসরি প্রথম বস্তুকে আঘাত না করে সেটির পাশের বাঁকানো পথ দিয়ে বেঁকে সামনে আসবে। এবং দ্বিতীয় বস্তু থেকে আলো যদি সামনে আসে আমাদের তবে আমরা সেই দ্বিতীয় বস্তুটি দেখতে পারবো!
যা বুঝা গেলো তা হলো, দ্বিতীয় বস্তু দেখতে পাওয়া মানে আসলে স্থানকাল বেঁকেছে। যদি দেখা না যায় তার অর্থ স্থানকাল বাঁকে নি। এখন, স্থানকাল যদি বাঁকে সেটি সরাসরি প্রমাণ করে এই ২৮ বছর বয়সের বিজ্ঞানীর কথা সত্য।
এখন কথা হচ্ছে, আলোর বাঁক নেবার জন্য স্থানকালের বক্রতা অনেক বেশি দরকার। ছোট-খাটো বক্রতা দিয়ে আলো বাঁক নিবে ঠিকই কিন্তু সেটি ধরতে পারা কঠিন। এখন এই মহাবিশ্বে বড়ো বস্তু মানেই সাধারণত নক্ষত্র। কিন্তু নক্ষত্র নিয়ে এই পরীক্ষা করলে ঝামেলা আছে। ধরা যাক, দুটি নক্ষত্র আছে। একটি নাম "কুদ্দুস" অপরটির নাম "আক্কাস"। "কুদ্দুস" নক্ষত্রের পিছে আছে "আক্কাস" নক্ষত্র। যেহেতু "কুদ্দুস" এর পেছনে "আক্কাস" আছে তাই নরমালি বলা যায় "আক্কাস" কে দেখতে পাওয়ার কথা না। কিন্তু আইনস্টাইনের তত্ত্ব ঠিক হলে আমরা "আক্কাস" কে দেখতে পাবো। কিন্তু যেহেতু "কুদ্দুস" একটি নক্ষত্র তাই "কুদ্দুস" এর আলোর জন্য আমরা "আক্কাস" এর বাঁকা আলো বুঝতে পারবো না কখনো। তাহলে উপায়?
উপায় একটা আছে! উপায়টা হচ্ছে সূর্যগ্রহণ! ইউরেকা! ব্যাপারটা ভেঙে বলছি। সূর্য একটি নক্ষত্র। অর্থাৎ সূর্য তার চারপাশের অদৃশ্য চাদর ভালই বাঁকিয়ে ফেলতে পারে। এখন সূর্যের পিছে যদি কোনো নক্ষত্র থাকে তবে আমরা সূর্যের এই স্থানকালের বক্রতার জন্য খুব সহজেই এর পিছের নক্ষত্র দেখতে পাবো! আর সূর্যগ্রহণের সময় তার আলোও কম থাকবে, ফলে পিছের নক্ষত্র থেকে আসা আলো সহজেই ধরতে পারবো আমরা!
চিত্র - ২: আলো যেভাবে বাঁক নেয়।
১৯১৯ সালের ২৯ মে। এদিন পূর্ণ সূর্যগ্রহণ হলো। বিজ্ঞানী এডিংটন এবং বিজ্ঞানী ফ্রাঙ্ক ওয়াটসন ডাইসন পর্যবেক্ষণ করে দেখলেন সূর্যের ঠিক পিছনে Hyades নক্ষত্র গুচ্ছ সূর্যের ঠিক পাশে সুন্দরভাবে দেখা যাচ্ছে, অথচ এর প্রকৃত অবস্থান সূর্যের ঠিক পেছনে। এটিকে দেখা যাচ্ছে কারণ সূর্যের তৈরি স্থানকালের বক্রতার কারণে ওই নক্ষত্র গুচ্ছের আলো সূর্যের পিছে আঘাত না করে বাঁকানো পথে বেঁকে সূর্যের সামনে এসেছে। তারা সেটির ছবি নিলেন।
চিত্র - ৩: বিজ্ঞানী এডিংটন এবং ফ্রাঙ্ক ওয়াটসন ডাইসন।
প্রমাণিত হয়ে গেলো পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে সুন্দর তত্ত্বের একটি। এবং তত্ত্বটি যে আসলেই ঠিক তার আরো প্রমাণ পাওয়া যায় বর্তমান সময়ে। ২০১৭ সালে যে তিনজন পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরষ্কার পান, সেই তিনজনের গবেষণার বিষয় ছিল "মহাকর্ষীয় তরঙ্গ"। "মহাকর্ষীয় তরঙ্গ"ও আজ প্রমাণিত সত্য এবং এর মূলে রয়েছে "সাধারণ আপেক্ষিতা তত্ত্ব"।
আসলে পদার্থবিজ্ঞানের প্রকৃত মজা পাওয়া যায় গণিতের মাধ্যমে। এই লেখাটি যারা প্রচন্ড ধর্যের সাথে এতো দূর পড়েছেন তাদের অনেকই হয়তো প্রায় কিছুই বুঝতে পারেননি। এইটা যেমন লেখক হিসেবে আমার ব্যর্থতা, তেমনি এর একটি প্রধান কারণ এই লেখায় কোনো গণিতের ব্যবহার হয় নি। যদি সত্যি আমরা গণিতের সাহায্যে পদার্থবিজ্ঞান বুঝি, তাহলে টের পাওয়া যাবে, আমাদের চারপাশের জগৎ গল্পের কাল্পনিক জগতের চেয়েও হাজারগুণ চমৎকার।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন