কামরূপ কামাখ্যার তাবিজ!



বাবার একজন কাছের বন্ধু আছেন। অতি উচ্চশিক্ষিত। অনার্স এবং মাস্টার্স করা।  পি.এইচ.ডি ডিগ্রি নিয়েছেন বিলেতের এক স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কথাবার্তা শুনলেই মনে হয় যথেষ্ট জ্ঞানী মানুষ। তাই আমিসহ আমাদের বাসার সবাই উনাকে খুব পছন্দ করে।

 উনি থাকেন রাজশাহীতে। যখন আমাদের এইদিকে আসেন তখন আমাদের বাসায় উঠেন। এইরকমই একদিন। তিনি কাজে এসেছিলেন। এক রাত থাকবেন আমাদের বাসায়। আমরা বেশ খুশি।

উনি বাসায় আসলেন আমাদের। আমার রুমে থাকবেন। একটু নাস্তা করে নিয়ে গোসলে গেলেন। আমি রুমে বসে কি জানি একটা কাজ করছিলাম, উনি গোসল থেকে বের হলেন। স্যান্ডো গেঞ্জী পড়া ছিলেন তিনি। আমি লক্ষ করলাম উনার ডান হাতে একটি কিম্ভুতকিমাকার তাবিজ! আমি তো অবাক!

কিছুক্ষণ আমি তাকিয়ে ছিলাম তাবিজটার দিকে। উনি খেয়াল করলেন সেটি। আমাকে বললেন তাবিজটা দেখিয়ে, "জানো এইটা কি?"

"জ্বী না আংকেল", একটু অস্বস্তি নিয়ে বললাম আমি।

"এইটা কামরূপ কামাখ্যার মন্দির থেকে নেওয়া। কালো শক্তি থেকে দূরে রাখে এইটা।"

"মানে? কীসের কালো শক্তি?"

"আরে কতো রকমের কালো শক্তি আছে। তুমি তো এখনও ছোট। বড়ো হও তুমি বুঝবা।"

আমি তো খাস বাংলায় "টাশকি" খেয়ে গেলাম! বলে কী লোকটা!

পরে বাবাকে বললাম এইটা নিয়ে। বাবাও কেমন জানি বোকা বনে গেলো ব্যাপারটা শুনে। মাথা চুলকে বললো, "ইয়ে মনে, দেখ উনি তো খুব জ্ঞানী মানুষ, পন্ডিত মানুষ। নিশ্চয়ই কারণ আছে।"

"মানে বলতে চাচ্ছো তুমি এইসব আগডুম বাগডুম তাবিজ পড়ে থাকা ঠিক?"

"ভুল কীভাবে বলি, উনি তো পন্ডিত মানুষ..."

ইংরেজিতে: I was dumbstruck!

উপরের ঘটনাটি পড়ার পর অনেকেই হয়তো ধরতে পেরেছেন এইটা কোন ধরনের লজিক্যাল ফ্যালাসি। ইংরেজিতে এই ফ্যালাসির নাম "Argument from authority fallacy", বাংলায় "প্রাধিকারের কুযুক্তি"।


কোন বিশিষ্ট ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে এক ধরণের কর্তৃত্ব আরোপ করা, সে কোনোকিছু সত্য হিসেবে ধীরে নিচ্ছে তাই সেটিকে সত্য হিসেবে ধরে নেওয়া এবং তার নামকে যুক্তি হিসেবে ব্যবহার করাকে কুযুক্তি হিসেবে গণ্য করা হয়। এই ধরণের ঘটনা কোনকিছু প্রমাণ বা অপ্রমাণ করতে পারে না। কোন বিখ্যাত বা বিশিষ্ট ব্যক্তি কী বলেছেন বা করেছেন বা শুনেছেন, তার ওপর যুক্তি নির্ভরশীল নয়। অর্থাৎ কে কী বললো সেইটা কোনোকিছুর সত্যতা যাচাইয়ের মানদণ্ড হতে পারে না।

যেমন, বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্স একজন নাস্তিক। আবার সর্বকালের অন্যতম সেরা বিজ্ঞানী নিউটন ছিলেন আস্তিক। রিচার্ড ডকিন্সের নাস্তিক হওয়া কোনোভাবেই প্রমাণ করে না যে ঈশ্বর নেই। আবার নিউটনের আস্তিক হওয়াও "ঈশ্বর আছেন" এইটা কোনোভাবেই প্রমাণ করে না। অর্থাৎ কেউ যদি বলে, "আরে রিচার্ড ডকিন্স তো নাস্তিক ছিল। তার মানে ঈশ্বর টিশ্বর বলে কিছু নেই। ওসব ভুয়া কথা", সেটি কোনোভাবেই ঈশ্বরের অস্তিত্বকে অপ্রমাণ করে দিবে না। একইভাবে, কেউ যদি এমনটা বলে, "আরে মিয়া নিউটন এতো বড়ো বিজ্ঞানী। উনি বলেছেন খোদা আছে। তার মানে অবশ্যই খোদা আছে", সেটি কোনোভাবেই ঈশ্বরের অস্তিত্বকে প্রমাণ করে না। মোট কথা, তারা বলেছেন বলেই কিছুকে পরম সত্য বলে মেনে নেওয়া একটি লজিক্যাল ফ্যালাসি। কিন্তু হ্যাঁ, সেইসব বিজ্ঞানী ঈশ্বরের পক্ষে বা বিপক্ষে কিসব দলিল, প্রমাণ বা যুক্তি দিয়েছে সেইটা অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু সে বিখ্যাত লোক বা জ্ঞানী লোক তাই উনি যা বলবেন তাই ঠিক, এমনটা করা চরম বোকামি।



বাবার সাথে আমার কথা খেয়াল করুন। আমি যখন বাবাকে বললাম আংকেল কামরূপ কামাখ্যার তাবিজ পড়ে তখন বাবা কোনো যুক্তি তর্কে না গিয়ে সরাসরি মন্তব্য করে বসলো, "ভুল কীভাবে বলি, উনি তো পন্ডিত মানুষ..." এটি একটি কুযুক্তি। উনি পন্ডিত বলে উনার তাবিজ সত্য হয়ে যায় না কোনোভাবেই। হ্যাঁ উনি যদি যুক্তি দেখিয়ে বলতেন কেন কি কারণে তাবিজ পড়েন, তবে সেই যুক্তি ও প্রমাণ যাচাই করে সেটিকে সত্য বা অসত্য বলা যেত।

যুক্তিবিদ্যায় খুবই পরিচিত কুযুক্তি এটি। কিন্তু প্রায় সময় আমরা নিজেরাও না বুঝে এমন কুযুক্তির আশ্রয় নেই। পরের বার থেকে যেন এইটা মাথায় থাকে আমাদের।


মন্তব্যসমূহ