এন্টি-ন্যাটালিজম: সন্তান জন্ম দেওয়া পাপ? (!)
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জনৈক ভারতীয় যুবক একটি অদ্ভুত কাণ্ড করে বসে। যুবকটির নাম রাফায়েল স্যামুয়েল। বয়স ২৭। রাফায়েল তার মা-বাবার নামে একটি মামলা করে। তার মা-বাবার অপরাধ: তাকে জন্ম দেওয়া!
জন্ম দেয়া কী আসলেই অপরাধ? এক ধরনের দার্শনিক অবস্থান অনুযায়ী, হ্যাঁ, কাউকে জন্ম দেওয়াটা অপরাধ! এই দার্শনিক অবস্থানের নাম Anti-natalism যার বাংলা করলে দাড়ায় প্রজনন বিরোধিতা। এই দার্শনিক অবস্থান নতুন মনে হলেও প্রাচীন গ্রীক সভ্যতা থেকেই ব্যাপারটির সূত্রপাত। কিন্তু Anti-natalism শব্দ প্রথম ব্যবহার সম্ভবত করেন বেলজিয়ান দার্শনিক থিওফাইল ডি জিরোড। এবং এটিকে জনপ্রিয় করেন দক্ষিণ আফ্রিকার দার্শনিক ডেভিড বেনাটার তার বই Better Never to Have Been এর মাধ্যমে।
ব্যাপারটা অনেকের কাছে অদ্ভুতুড়ে লাগতে পারে! লাগলেও কিছু করার নেই। এই দার্শনিক অবস্থান প্রতিনিয়ত জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। একটি উদাহরণ দিলেই বুঝবেন। রেডিটে এন্টি-ন্যাটালিজমের যে সাবরেডিট আছে তার মেম্বারের সংখ্যা ৭৩ হাজারেরও বেশি!
কী এই এন্টি-ন্যাটালিজম? এরা কী যুক্তি দেখায় প্রজনন না করার বিরুদ্ধে? একটু জেনে আসা যাক।
জন্ম হলে আনন্দ পাওয়া যায়, সুখ লাভ করা যায়। কিন্তু একই সাথে থাকে দুঃখ। সুখ পেতে চায় সবাই কিন্তু (সাধারণত) দুঃখ কেউ পেতে চায় না। আর যদি কেউ দুঃখ পেতেই চায় তবে এক্ষেত্রে তার অনুমতি লাগবে। আপনি কাউকে অনুমতি ছাড়া দুঃখ অথবা সুখ কিছুই দিতে পারেন না।
যেহেতু জন্মের আগে কোনো ছেলে বা মেয়ের কাছ থেকে তার অনুমতি নেওয়া যায় না যে সে জন্ম পরবর্তী সুখ-দুঃখ নিতে চায় কিনা, তাই তাকে জন্ম দেওয়া একটি অমানবিক কাজ, একটি অপরাধ। অনুমতি না নিয়ে কারো সাথে যেকোনো কাজ করাই অন্যায় (যেমন ধর্ষণ)। একটি সন্তান জন্মের পর যদি কোনো কারণে বলে, যদি না জন্মাতাম তবেই ভালো ছিল। তবে তাকে জোর করে এই পৃথিবীতে আনার দায়ভার তার জন্মদাতা এবং জন্মদাত্রীকে নিতে হবে। জন্ম যদি না হতো তার তবে সে সুখের ছোয়া পেত না ঠিকই কিন্তু তার কোনো দুঃখ ও পেতে হতো না। তার যাবতীয় দুঃখের একমাত্র কারণ তার মা-বাবা। প্রজনন বিরোধীদের মূলকথা এইটাই!
কিন্তু এইটা সবাই জানে, (সাধারণত) মা-বাবার তো নিয়ত থাকে না সন্তানকে কষ্ট দেবার। তারা সব সময় চায় তাদের সন্তান যেন ভালো থাকে, মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ প্রতিভা ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর যেমনটা লিখেছিলেন, আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে। তাই অনেকে এই প্রশ্ন করে থাকে, আপনি নিয়ত দেখবেন না?
প্রজনন বিরোধীরা বলে, এক সময় পিতারা মনে করতেন ঈশ্বরের নামে সন্তান বলি দেয়া একটি ভালো কাজ, পুণ্যের কাজ। তারা সন্তান বলি দিত খুবই নেক নিয়তে। যেমন, এককালে গ্রীক দেবতা "জিউস" এর নামে লাখ লাখ শিশু বলির শিকার হতো। যারা বলি দিত তারা শিশুদের প্রতি চরম আক্রোশ থেকে বলি দিত না। তারা ভাবত এতে দেবতা খুশি হবে এবং মৃত্যু-পরবর্তী জীবনে শিশুরা সুন্দর জীবন পাবে। এদের সকলের নিয়ত ভালো ছিল, কিন্তু তাদের কাজ কি ভালো ছিল? তাদের নিয়ত ভালো দেখে তাদের সন্তান বলি দেওয়া কি ভালো কাজ হয়ে যায়? একজন জন্মদাতা এবং জন্মদাত্রী যখন জানে তার সন্তানকে কষ্ট ভোগ করতে হবে এই পৃথিবীতে আসার পর, এইটা জেনেও সন্তানকে জন্ম দেওয়া জোর করে তাকে কষ্টের সামনে, দুঃখের সামনে ঠেলে দেওয়া নয়? তাদের নিয়তের কী আদৌ কোনো দাম আছে?
আবার অনেকে বলেন, তাদের অনুমতি নেওয়ার তো সুযোগ ছিল না। থাকলে তো অবশ্যই নিতেন। কিন্তু ব্যাপারটা হলো, তাদের মতে জন্ম দেওয়াটা অপরাধ কারণ জন্মের আগে অনুমতি নেওয়ার সেই সুযোগটা থাকে না, যদি থাকতো তবে এটি অপরাধ হতো না।
আপনারা প্রায় সবাই জানেন অপ্রাপ্ত বয়সের যে কারো সাথে কোনো প্রকার যৌন কর্ম করা ধর্ষণ। কেননা, অপ্রাপ্ত বয়সের ছেলে বা মেয়ে স্বাধীনভাবে নিজেদের অনুমতি দিতে পারে না, কারণ তাদের চিন্তাভাবনা অপরিপক্ক। এজ অব কন্সেন্টে তারা পৌছায়নি। যেহেতু তারা অনুমতি দেওয়ার সক্ষমতা অর্জন করতে পারে নি তাই তাদের না জানা সম্ভব না আবার হ্যাঁও জানা সম্ভব না। সেই শারীরিক সম্পর্কে তাদের হ্যাঁ থাকলে সমস্যা নেই, কিন্তু যেহেতু তাদের না থাকার সম্ভাবনাও একই তাই বলা হয় তাদের সাথে শারীরিক সম্পর্ক করা যাবে না। করলে সেটি ধর্ষণ হবে। যদি জন্ম দেওয়া অপরাধ না হয় তবে অপ্রাপ্ত বয়স্কদের সাথে শারীরিক সম্পর্কও ধর্ষণ নয়।
এখন এইখানে একটি কথা আছে। যারা নাস্তিক তাদের আসলে খুব একটা সুযোগ নেই ধুম করে প্রজনন বিরোধিতার বিরুদ্ধে একটি কাউন্টার দেওয়া। কিন্তু যারা আস্তিক, বিশেষ করে ধর্ম যে ঈশ্বরের কথা বলে সেই ঈশ্বরে বিশ্বাসী, তারা খুব সহজেই বলে দিতে পারে, আল্লাহ্ চায় দেখে বাচ্চা হয় আর তাছাড়া সুখ দুঃখের মালিক তো ঈশ্বর! কিন্তু এতেও ঘাপলা আছে। কি ঘাপলা আছে সেটি বলছি না, নিজেরা চিন্তা করে বের করে আমার লেখার নিচে মন্তব্য করতে পারেন, আমি বসে বসে পড়বো এবং উত্তর দিব।
প্রজনন বিরোধীরা আরো যেটা বলেন সেটা হলো, সন্তান না নিলে জনসংখ্যা কমবে, প্রকৃতির উপর চাপ কম হবে, পরিবেশ দূষণ কমবে ইত্যাদি। কিন্তু তাদের মূল বিষয়বস্তু ওইটাই, অর্থাৎ সন্তান জন্ম দেওয়া একটি অমানবিক কাজ এবং এটি একটি অপরাধ।
যাইহোক, এই হলো প্রজনন বিরোধিতা বা Anti-natalism এর বিষয়ে প্রাথমিক ধারণা। আমি এর পক্ষে বা বিপক্ষে না। এই বিষয়টা নিয়ে আলোকপাত করা ছিল আমার মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু হ্যাঁ, এই বিষয় নিয়ে চিন্তা করলে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হবার একটা সুযোগ থাকে।
শেষে ফিরে আসছি আবার সেই রাফায়েল স্যামুয়েলের কাছে। দ্যা গার্ডিয়ান পত্রিকায় দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে রাফায়েল বলেন, তিনি মুম্বাইতে চমৎকার একটি জীবন যাপন করছেন, এবং তিনি তার মা-বাবারও খুব ঘনিষ্ট। তবে তার এই মামলা করার কারণ কি! দুমুখো সাপ টাইপের কিছু নাকি? ব্যাপারটা আসলে তা না। সেই সাক্ষাৎকারেই রাফায়েল বলেন যে, তিনি এমনটা করেছেন যেন সর্বস্তরের মা-বাবাদের মধ্যে একটি ভয় ঢুকিয়ে দিতে পারেন, কেননা বর্তমানে অনেক মা-বাবারা সন্তান জন্ম দেবার আগে একটুও চিন্তা করে না অনাগত সন্তানটির ব্যাপারে। মামলাটিতে তার মা-বাবার কাছ থেকে তাকে জন্ম দেওয়ার জন্য এক রুপির মত টাকা জরিমানা দাবি করেছিল রাফায়েল, অর্থাৎ পুরো মামলাটি ছিল প্রতীকমূলক!
সর্বশেষ কথা, মানুষ যে দর্শন বা যে মতবাদেরই সমর্থক হোক না কেন, এতে যেন করো অধিকার হরণ না হয়, এইটা আমাদের সব সময় লক্ষ রাখতে হবে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন