হোমিওপ্যাথির ভাঁওতাবাজি!
একদম শুরুতেই একটি কথা বলে নেই। এবং বলার আগে একটু মন খুলে হেসে নেই। এবং হাসার পর একটু তাঁদের জন্য একটু শোক পালন করি যারা হোমিওপ্যাথির উপর অগাধ অন্ধবিশ্বাস রেখে আসছে এতদিন। কারণ এই লেখার জন্য এই বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করার সময় প্রথমেই স্বাভাবিকভাবে গুগল করলাম। উইকিপিডিয়াতে দেখলাম প্রথম বাক্যে এইটা লেখা আছেঃ Homeopathy or homoeopathy is a pseudoscientific system of alternative medicine. যার বাংলা করলে দাঁড়ায়ঃ হোমিওপ্যাথি বিকল্প ওষুধের অপবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি।
হোমিওপ্যাথি নামক ভাঁওতাবাজি বর্তমান পৃথিবীর অশিক্ষিত দেশে এবং অশিক্ষিত অন্ধ সমাজে তুমুল ব্যাবসা করে চলছে, যদিও এর জনপ্রিয়তা আগের চেয়ে অনেক কম। কিন্তু কেউ কেউ এখনো এটিকে বিশুদ্ধ বিজ্ঞান বলে বিশ্বাস করেন বৈকি! হোমিওপ্যাথি এখন এই পৃথিবীর বুকে টিকে আছে এর কারণ মানুষের ভয় এবং অন্ধবিশ্বাস এবং বিজ্ঞান সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানের অভাব। অথচ পৃথিবীর অনেক সভ্য সমাজে হোমিওপ্যাথিকে নিষিদ্ধ করেছে, কেননা হোমিওপ্যাথি মানুষ ঠকায়!
হোমিওপ্যাথির লুঙ্গিতে টান দেবার আগে চলুন দেখে নেই এর ইতিহাস।
হোমিওপ্যাথির জন্ম দেখতে হলে আমাদের চলে যেতে হবে ১৮ শতকে। তখনকার চিকিৎসাবিজ্ঞান আজকের মত একদমই ছিল না। ছিল নানান রকমের কুপ্রথা, বিচিত্র-অনুষ্ঠান। ছিল বেশ জটিল এবং বেশ বর্বর কিছু প্রক্রিয়া। এই ব্যাপারগুলো একজন চিকিৎসকের ভাল লাগেনি। তিনি চাচ্ছিলেন এসবের থেকে একটু ভিন্ন রকমের চিকিৎসা পদ্ধতির, যা এসবের থেকে হবে বেশ সরল। এভাবে একসময় তিনি একদম অন্যরকম একটি চিকিৎসা পদ্ধতির জন্ম দেন। সেই চিকিৎসাপদ্ধতির নামই হল হোমিওপ্যাথি। এই নতুন চিকিৎসাপদ্ধতির জনক হলেন ক্রিশ্চান ফেড্রিক স্যামুয়েল হানিম্যান, ছিলেন একজন জার্মান চিকিৎসক। বেশ দ্রুত তার এই হোমিওপ্যাথি বিপুল জনপ্রিয়তা পেতে লাগলো। প্রচুর মানুষ এর মাধ্যমে সুস্থ হতে থাকলো। এভাবেই, হোমিওপ্যাথি একটি বিকল্প চিকিৎসাপদ্ধতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল। (?)
চিত্র- ২ ঃ ক্রিশ্চান ফেড্রিক স্যামুয়েল হানিম্যান, হোমিওপ্যাথির জনকএবার চলুন হোমিওপ্যাথির লুঙ্গিতে টান দেই।
হোমিওপ্যাথির ভাঁওতাবাজি বুঝতে হলে প্রথমে এর ঔষধ বানানোর প্রক্রিয়া জানতে হবে। একটি হোমিওপ্যাথির ঔষধ দুটি ধাপে বানানো হয়।
১। Like cures Like:
ঔষধ বানানোর প্রথম ধাপ এটি। "লাইক কিওর্স লাইক" কথাটির মানে হল, রোগ নিরাময়ের জন্য সেই উপাদান নিতে হবে যা খেলে রোগ বেড়ে যায়! জ্বী হ্যাঁ, আপনি ভুল পড়েননি। ধরেন আপনার প্রচণ্ড জ্বর। এবং বেলাডোনা খেলে জ্বর কমে যাওয়ার বদলে উল্টা বেড়ে যায়। তাই হোমিওপ্যাথিতে জ্বর হলে বেলাডোনা খাওয়ান হয়! কিন্তু সরাসরি কি খাওয়ানো হয়? মোটেও না। কীভাবে সেটি উৎপাদন করে তা বুঝতে হলে পরের ধাপে যেতে হবে, যা প্রথম ধাপের চেয়েও হাস্যকর!
২। Potentiation:
"পোটেনসিয়েশন" এর শাব্দিক অর্থ হল কোনো কিছুর শক্তি বাড়িয়ে দেওয়া। হোমিওপ্যাথিতে "পোটেনসিয়েশন" এর পদ্ধতি চরম হাস্যকর! এই অপবৈজ্ঞানিক চিকিৎসাশাস্ত্র অনুযায়ী, রোগের মূল ঔষধকে বার বার পানিতে বা অ্যালকোহলে ঝাঁকিয়ে মিশ্রিত করলে এর নিরাময় ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়! এবং এটি যত বেশি বেশি এমন করা হবে এর ক্ষমতা তত বৃদ্ধি পাবে। আরেকটু ভেঙ্গে বলি।
ধরেন আমরা বেলাডোনার ঔষধ তৈরি করবো। অর্থাৎ "পোটেনসিয়েশন" করবো। এর জন্য প্রথমে আমরা দশ ভাগের এক ভাগ (১/১০) বেলাডোনা নিবো এবং দশ ভাগের বাকি নয় (৯/১০) ভাগ পানি নিবো। তারপর মোট এই দশ ভাগ মিশ্রন ভাল করে ঝাঁকাবো। তখন যে মিশ্রন তৈরি হবে তাকে বলা হবে বেলাডোনা 1x। তারপর ওই মিশ্রনের দশ ভাগের এক ভাগ নিয়ে বাকি নয় ভাগ আবার পানি নিবো এবং সেটি ঝাঁকাবো ভালমত। দ্বিতীয় মিশ্রন হবে বেলাডোনা 2x। এভাবে করতে করতে আসবে 30x, 40x, 50x ইত্যাদি! এবং এই সংখ্যা যত বৃদ্ধি পাবে, তত ভাল ঔষধ হবে সেটি। অর্থাৎ, বেলাডোনা 20x থেকে বেলাডোনা 30x বেশি শক্তিশালী! এমনও হয় শেষে গিয়ে মূল ঔষধের একটি পরমাণুও সেই মিশ্রনে উপস্থিত থাকে না! থাকবে কীভাবে, একটি 20x মিশ্রনের এক চামচ মানে হল অ্যাটলানটিক মহাসাগরের সমপরিমাণ পানিতে একটি নাপার ট্যাবলেট মিশিয়ে সেই মিশ্রনের এক চামচ! আবার, 30c হোমিওপ্যাথি ঔষধ মানে হল এক ভাগ মূল ঔষধ এবং বাকি ১০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০ ভাগ পানি! হোমিওপ্যাথির ভাষ্য অনুযায়ী এভাবে করলে সেই মূল ঔষধের একটি সত্ত্বা সেই পানির মধ্যে ঢুকে যায় এবং যত সূক্ষ্ম সেই মিশ্রন হয়, তত ভালভাবে সেই মূল ঔষধের সত্ত্বা তাতে ঢুকে পড়ে। (আড়ালে সেই সত্ত্বাকে মূল ঔষধের আত্মাও বলে!) এবং এতে করে ঔষধের শক্তি অনেক বেড়ে যায়! যদি তাঁদের যুক্তি ধরে নেই তবে আমরা ফিল্টার করে যে পানি খাই ওইটা খুবই চমৎকার হোমিও ঔষধ!
চিত্র- ৪ঃ বেলাডোনা ঔষধ
এই দুই ধাপে মূলত হোমিওপ্যাথি ঔষধ বানানো হয়। যারা মোটামুটি বিজ্ঞান কীভাবে কাজ করে তা বুঝেন, তারা খুব ভাল করেই হোমিওপ্যাথির ধাপ্পাবাজি ধরে ফেলেছেন। কিন্তু যারা জানে না বিজ্ঞান কীভাবে কাজ করে তারা হয়তবা ব্যাপারটা ধরতে পারেননি। তাদের জন্য বলব শামীর ভাইয়ের এই লেখাটি পড়ে আসতেঃ বিজ্ঞান কীভাবে কাজ করে।
সব কিছুই বুঝলাম, কিন্তু কথা হচ্ছে হোমিওপ্যাথি খেয়ে তো অনেকে উপকার পায়; যদি এটা ধাপ্পাবাজি হয়েই থাকে তবে এটি কাজ দেয় কীভাবে?
এর মূলত দুটি কারণ আছে। এক হল প্লাসিবো এফেক্ট এবং আরেকটি আমাদের সাধারণ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। আপনারা যারা ইতিমধ্যে শামীর ভাইয়ের লেখাটি পড়ে এসেছেন তাঁরা প্লাসিবো এফেক্ট নিয়ে জানেন। কিন্তু যারা জানেন না তাদের অল্প করে বললে বলবো, আপনি যখন কোনো কিছু পরম বিশ্বাসে খান, তখন আপনার শরীর এটিকে সত্যিকারের ঔষধ ভাবে এবং নিজে থেকেই রোগ নিরাময় করে! ধরেন, আপনার পেটে প্রচুর ব্যাথা। ডাক্তার আপনাকে ঔষধের নাম করে ময়দার গোলা খাইয়ে দিলে। আপনি সেই ময়দার গোলা ডাক্তার দিয়েছে দেখে পরম বিশ্বাসে খেয়ে নিলেন। দেখবেন আপনার পেটের ব্যাথা নেই! (ব্যাপারটা যে সবসময় কাজ করে এমনটিও নয়) ব্যাপারটা অদ্ভুতুড়ে শুনালেও এটি খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার এবং প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক সত্য! যারা আরও বিস্তারিত এটি নিয়ে জানতে চান তারা ইন্টারনেটে ঘাঁটলেই এর ব্যাপারে অনেক কিছু জানতে পারেবেন। আপনি যখন পরম বিশ্বাসে একটি হোমিওপ্যাথিক বড়ি খাবেন তখন যদি সুস্থ হন, তবে সেটির ক্রেডিট আপনার পরম বিশ্বাসের, সেই বড়ির নয়! এখন আসি দ্বিতীয় কারণটিতে, অর্থাৎ দেহের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতায়। দেহে যদি কোনো কিছু হয় তবে দেহ নিজে নিজেই সেটিকে চিকিৎসা দেয়। এখন ধরেনন আপনি একটি ময়দার গোলা খেলেন এবং দেখলেন কয়েকদিন পর ঠিক হয়ে গেলেন। সেটি ঠিক হয়েছেন কেননা সেই কয়েকদিনে আপনার শরীর নিজে থেকেই রোগটিকে নিরাময় করেছে। এইখানে ময়দার গোলার কোনোই ভূমিকা নেই! হোমিওপ্যাথি এইভাবেও আরেকজনের ক্রেডিট চুরি করে!
চিত্র- ৫ ঃ হোমিওপ্যাথি একটি ধাপ্পাবাজি ছাড়া আর কিছুই নয়!
এখন অনেক হোমিওপ্যাথির মুরিদ এসে গলা ফুলায় বলবে, কোনো বৈজ্ঞানিক রিসার্চ কী হোমিওপ্যাথিকে ভুল প্রমাণ করেছে? তাদের জন্য আমি কতগুলো পিয়ার-রিভিউ জার্নালের নাম উল্লেখ করছিঃ দ্যা ল্যান্সেট, দ্যা ইউরোপিয়ান জার্নাল অব ক্যান্সার, দ্যা জার্নাল অব অল্টারনেটিভ এন্ড কমপ্লিমেনটারি মেডিসিন ইত্যাদি (এবং এমন অসংখ্য জার্নাল আছে যারা হোমিওপ্যাথি নিয়ে গবেষণা করেছে) এক কথায় হোমিওপ্যাথিকে ভুয়া বলেছে। তারপর অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় স্বাস্থ্য এবং ঔষধ গবেষণা অধিদপ্তর (যা পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ একটি গবেষণা সংস্থা) একটি চমৎকার গবেষণা করে এটির উপর এবং পরিষ্কারভাবে বলে হোমিওপ্যাথি প্লাসিবো ছাড়া কিছুই না! আমি তো মাত্র কয়েকটির নাম উল্লেখ করলাম, কিন্তু দেখা যায় প্রায় সকল গবেষণা সংস্থাই হোমিওপ্যাথিকে ভাঁওতাবাজিই বলে!
আশা করি কোনো হোমিওপ্যাথি ভক্ত যদি কষ্ট করে এতদূর পড়ে তবে তার হোমিওপ্যাথির উপর বিশ্বাস উঠে গেছে। কিন্তু যারা একবারে অন্ধ তাদের কিছুই হবে না। তাই তাদের কথা বাদ। সকলের কাছে শেষে এতটুকুই বলবো এইসব অপ-চিকিৎসার উপর নির্ভরতা কমাতে একদম। কেননা তারা আপনার অজ্ঞতাকে পুঁজি করে এর মাঝে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার কামাই করেছে, ধারণা করা হয় এই মার্কেট ২০২৪ সালের মধ্যে ১৭ বিলিয়ন ডলার কামাই করবে! একটা ইন্ডাস্ট্রি শুধু মাত্র ভাঁওতাবাজি দিয়েই এত এত টাকা কামাই করছে, যে টাকা দিয়ে কত কত অভুক্ত শিশুর পেট ভরে যেত, কত না মানুষ পেত শিক্ষার আলো, কত মানুষ সঠিক চিকিৎসা পেত! এটা কী কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায়!
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন