আমি, টুলি বেগম ও রুপালী রাতের চাঁদ


 
মায়ের থেকে মায়ের আদর পাইনি, বাবার থেকে বাবার আদর পাইনি। রাস্তায় অনাদরে, অবহেলায় মানুষ হয়েছি। ভিক্ষা করে খেয়েছি আমি। খেয়ে যখন একটু বড় হয়েছি, তখন লোকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাজ করে খেয়েছি; তাও ভালো ভাত খেতে দেয়নি, পানি দেয়া ভাত খেতে দিয়েছে আমাকে। তাই-ই খেয়ে থেকেছি। এরপর গার্মেন্টসের এক ছেলের সাথে বিয়ে হয় ঢাকায়। সেই ছেলে আমার সাথে আট মাসের মতো সংসার করে বাড়ি যায়। আর ফেরত আসেনি। আড়াই মাসের এক বাচ্চা তখন আমার পেটে। দুঃখের বিষয় কি জানানে? সেই আড়াই মাসের এক বাচ্চা পেটে নিয়ে আমি রাজমিস্ত্রির কাজ করেছি, কিন্তু সেই ছেলে আজ পর্যন্ত কখনো আমাকে মা বলে পরিচয় দেয়নি।
 
বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন টুলি বেগম, ব্যাটারিচালিত রিকশা চালিয়ে আজকাল জীবিকা নির্বাহ করেন যিনি। ফেসবুকে এক রাতে স্ক্রল করতে করতে ভিডিও ক্লিপটি আমার সামনে আসে, যেখানে টুলি বেগম নিজের জীবনের এই কথাগুলো বলেন। ভিডিওটি দেখার পর সাথে সাথেই আমার মনে পড়ে গেল আলবেয়ার কাম্যুর ১৯৪২ সালের বই "দ্যা মিথ অব সিসিফাস" এর প্রথম দুই লাইন, There is but one serious philosophical problem, and that is suicide. Judging whether life is or is not worth living amounts to answering the fundamental question of philosophy, যার বাংলা করলে দাঁড়ায়, একটি কিন্তু খুবই গুরুতর দার্শনিক সমস্যা রয়ে গেছে, আর তা হলো আত্মহত্যা। জীবন আসলে যাপন করার যোগ্য কিনা তা বিচার করা দর্শনের মৌলিক প্রশ্নের উত্তর দেয়ার সমান। 
 
একজন মানুষ কেন জীবনকে যাপন করার যোগ্য ভেবে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখবে? কেন সে আত্মহত্যা করবে না? কেন সে জেনে-বুঝে জীবনের ছুঁড়ে দেয়া নির্মম আঘাতগুলোকে মাথা পেতে নেবে? কেন সে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়ে চিরতরে সকল দুঃখের অবসান ঘটাবে না? এই প্রশ্নটি খুব সাংঘাতিক রকমের ট্রিকি। এইযে টুলি বেগম সারাটা জীবন এতোটা নির্মমতার শিকার হয়েও কেন এখনো রিকশা চালিয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখছেন? কেন তিনি আত্মহত্যা করছেন না, কিংবা আগে করেন নাই, এই প্রশ্নের দিয়েই আলবেয়ার কাম্যু বইটি শুরু করেছেন এবং বই জুড়ে প্রশ্নটি ডিল করার চেষ্টা করেছেন। শুধু ক্যামু না, ওয়েস্টার্ন ফিলোসফারদের মধ্যে প্রায় সকলেই কমবেশি এই প্রশ্ন নিয়ে ডিল করেছেন। কয়েকজনের নাম না নিলেই নয়, যেমন জঁ-পল সার্ত্র, ফ্রেইডরিচ নিৎচা, সোউরেন কিয়েককেগার্ড, কার্ল মার্ক্স প্রমুখ। আবার আমাদের এই দিকে এধরনের সংকটের মূলে থাকা দুঃখকে নিয়ে ডিল করেছেন গৌতম বুদ্ধ। শুধু গৌতম বুদ্ধ কেন, এই ধরনের সমস্যা ডিল করেছেন নবীজি (স.), করেছে যীশু খ্রিষ্টও। কে করেননি?
 
সোউরেন কিয়েককেগার্ডকে দিয়ে শুরু করি। কিয়েককেগার্ড একজন ড্যানিশ দার্শনিক। বলা হয়ে থাকে তিনি পৃথিবীর প্রথম একজিসটেনশিয়ালিস্ট ফিলোসফার বা অস্তিত্ববাদী দার্শনিক। তিনি সরাসরিভাবে অন্যান্য পশ্চিমা অস্তিত্ববাদী দার্শনিক যেমন জঁ-পল সার্ত্র, আলবেয়ার কাম্যু, মার্টিন হাইডেগার প্রমুখদের প্রভাবিত করেছেন। সকল দার্শনিকদের মতো কিয়েককেগার্ড খুবই অদ্ভুত এক চোখে আমাদের চারপাশের দিকে তাকিয়েছেন, বিশেষ করে মৃত্যুর দিকে। এর পেছনে কারণ ছিল অবশ্য। কিয়েককেগার্ডের বয়স বাইশ হতে না হতেই তাঁর ছয় ভাইবোনের মাঝে পাঁচজনই মারা যায়। মৃত্যু তাঁকে তাই গভীরভাবে প্রভাবিত করে। তিনি নিজেও মারা যান মাত্র ৪২ বছর বয়সে। ফলত তাঁর দর্শন থেকে জীবন নিয়ে, বেঁচে থাকা নিয়ে, মৃত্যু নিয়ে বেশ কিছু ইন্টারেস্টিং জিনিস আমরা পাই। 
 
তিনি বার বার জীবনের অর্থ, বেঁচে থাকার অর্থ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। উত্তর দেবারও চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেন যে, বড় হতে হতে আমি চোখ খুলে চারদিকে তাকাই এবং আসল পৃথিবীকে দেখতে পেয়ে হাসতে থাকি, হাসতেই থাকি। সেই হাসি আমার এখনো থামে নাই। 
 
তিনি দেখতে পান পৃথিবীর একেক মানুষ জীবনকে অর্থবহ করে তুলতে একেক কাজ করছে, কিংবা বিশ্বাস করছে, এইসব এইসব করলে নাকি জীবন সার্থক হয়। যেমন, কেউ ভাবছে সরকারী চাকরী পেলেই জীবন সার্থক, কেউ ভাবছে কলেজের সব থেকে সুন্দরী নারীকে পটাতে পারলে জীবন সার্থক, আবার কেউ ভাবছে একটা মনের মতো উপন্যাস লিখতে পারলে জীবন সার্থক। তিনি বলেন, বিয়ে করলেও তুমি রিগ্রেট করবে, বিয়ে না করলেও রিগ্রেট করবে। বিয়ে করো কিংবা না করো, রিগ্রেট করবেই তুমি।... তুমি গলায় দড়ি দিলেও রিগ্রেট করবে, দড়ি না দিলেও একইরকমভাবে রিগ্রেট করবে। রিগ্রেটের জন্ম তোমার হবেই, অর্থাৎ, যা-ই করি না কেন পরিপূর্ণতা কোথাও পাবো না। হা-হুতাশ আমাদের রয়েই যাবে। 
 
কিয়েককেগার্ডের বলেন, জীবনকে বুঝতে হলে তোমার পিছে তাকাতে হবে ঠিকই, কিন্তু সেটাকে যাপন করতে হবে সামনের দিকে মুখ করে। তিনি আরো বলেন, যে কেউ একটু সিরিয়াসলি এইসব নিয়ে ভাবলে বুঝতে পারবে, কারো পক্ষেই আসলে পরম সুখ কিংবা সবদিক দিকে পরিপূর্ণতা অনুভব করা সম্ভব নয়, এমনকি আধা ঘণ্টার জন্যও নয়। না কেঁদে কেউই এই পৃথিবীতে আসে নাই। কেউ জিজ্ঞেস করে না তুমি এই পৃথিবীতে আসতে চেয়েছিলে কি চাওনি। কেউ তোমাকে জিজ্ঞেসও করে না কখন তুমি এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে চাও। হায় রে! কি শূন্য ও অর্থহীন এই জীবন! আমরা একজন মানুষকে দাফন করি, তাঁর দিকে তিন কোপ মাটি ছুঁড়ে দেই, বাড়ি ফিরি এবং নিজেকে সান্ত্বনা দেই এই বলে যে আমাদের বেঁচে থাকার মতো যথেষ্ট জীবন পড়ে আছে! কিন্তু তিন আর দশের মধ্যে কি এমন পার্থক্য? কেন এই জীবনকে আমরা শেষ করে দিচ্ছি না?
 
এখন তাহলে এই ধ্রুব হতাশার থেকে মুক্তি কোথায়? এই জীবন নামক জটিল জিনিস, এই অস্তিত্বের সংকট থেকে মুক্তি কোথায়? তিনি বলেছেন, মুক্তি যদি থেকেই থাকে তবে সেটা ঈশ্বরের মাঝে আছে। কিয়েককেগার্ড লিখেন, "To have faith is to lose your mind and to win God." তিনি বারবার লিপ অব ফেইথ এর কথা বলেছেন। কিয়েকেগার্ডের মতে আমরা যা কিছুই উন্নতি করি না কেন, যত যা কিছুই করি না কেন, আমাদের কষ্ট থেকেই যাবে। ফলত, যদি এসব থেকে বাঁচতেই হয় তাহলে ঈশ্বরের পথ ধরো। আর কোনো উপায় নেই। 
 
কার্ল মার্ক্স অবশ্য এই অবস্থানের তীব্র সমালোচনা করেছেন। মার্ক্সের মতে মানুষের যাবতীয় দুঃখের কেন্দ্রে রয়েছে সামাজিক কদাচার। কদাচার দূর করলে, সেই কদাচারের সাথে ফাইট করলে তবে প্রকৃত শান্তি মিলবে, মানুষ বেঁচে থাকার রসদ পাবে, অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার কারণ খুঁজে পাবে। কিন্তু ঈশ্বরের চিন্তায় মশগুল হলে মানুষ সেই কদাচারকে ওভারলুক করে যাবে। 
 
যেমন, ধরুন, এলাকার পাতি নেতা দলবলসহ আপনার এক সন্তানকে হত্যা করলো কুপিয়ে কুপিয়ে। এখন ধরেন আপনি এই নিয়ে শান্তিতে রইলেন যে, ঈশ্বরের সৃষ্টি ঈশ্বর নিয়ে গেছে; জীবনে তো সে আজকে হোক কালকে হোক মারাই যেত; কি আর করা যাবে বলো; অর্থাৎ আপনি এই কদাচারের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপই নিলেন না, না নিয়ে ওইসব ভেবেই শান্তিতে থেকে গেলেন। 
 
মার্ক্স বলছেন, এমনটা হলে বিরাট এক ফ্যাসাদের সৃষ্টি হবে। আজকে এক সন্তানকে তারা হত্যা করেছে, কালকে আরেকজনকে করা হবে। দুইদিন পর আপনার জমিজামা হাতিয়ে নেবে। তিন দিনের মাথায় আপনার প্রিয়তমা স্ত্রীর বস্ত্রহরণ করবে। তখন কি করবেন আপনি? আপনার ঈশ্বরই বা কি করবে?
তাই মার্ক্স ঈশ্বরের কন্সেপটের এই দিক দিয়ে বিরোধী ছিলেন। তিনি মনে করতেন ঈশ্বরে প্রবল বিশ্বাসী একজন মানুষকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে খুব সহজেই একটি অন্যায়কে ন্যায়ে পরিণত করা যায়। ফলে, সেই মানুষই আল্টিমেটলি নিগৃহীত হয়, অত্যাচারিত হয়। তিনি চান, মানুষ যেন সকল ধরনের অনাচার-কদাচার থেকে মুক্ত হতে পারে। হতে পারলে তবেই প্রকৃত শান্তি। তবেই সুখ। 
 
কার্ল মার্ক্সের ভক্ত ছিলেন ফরাসি দার্শনিক জঁ-পল সার্ত্র। অস্তিত্ববাদী দার্শনিক ছিলেন তিনি, ছিলেন সেরাদের একজন। সার্ত্রে মানুষের ভেতরে থাকা অসীম সম্ভাবনাকে, আমাদের লুকায়িত শক্তিকে বারবার নমস্কার জানিয়েছেন। তিনি আমাদের চারপাশের জগতটাকে গতানুগতিক চোখে না দেখে একটু ভিন্ন চোখে দেখতে বলেছেন।
 
যেমন তিনি নিজেই জীবনের অর্থহীনতার সংকটকে এইভাবে ব্যাখ্যা করেছেন যে, জীবনের কোনো অর্থ না থাকাটা বড়ই শান্তির। জীবনের কোনো অর্থ থাকলে, আমাদের বেঁচে থাকার কোনো অর্থ রইলে সেই অর্থের পিছে ছুটতে ছুটতে আমাদের জীবন পানি হয়ে যেত। যেহেতু জীবন মিনিংলেস তাই সেইসব দৌড়ঝাপ থেকে বাঁচা গেল। চাইলেই আমরা যা ইচ্ছা তা করতে পারবো, যা আমাকে শান্তি দিবে। সার্ত্রের সাথে টুলি বেগমের দেখা হলে তিনি হয়তো বলতেন, ‘আপা, আপনার ছেলে অপদার্থ হয়েছে তো কি হয়েছে? দুনিয়াতে কতো ছেলে আছে যার মা নেই। আপনি সেইরকম এক ছেলের মা হয়ে যান। ওই ছেলে আপনাকে এতো এতো এতো ভালোবাসা দিবে যে আপনার জীবনের যাবতীয় সব কষ্ট নিমিষেই গায়েব হয়ে যাবে।’ 
 
মানুষের এই চিরায়ত দুঃখ-কষ্ট নিয়ে বেশ অন্যরকমের এক অবস্থান নিয়েছিলেন জার্মান দার্শনিক ফ্রেইডরিচ নিৎচা। নিৎচা বলেন যে, দুঃখ-কষ্টই যদি তোমার জীবনে না থাকে তবে এই জীবন রেখে লাভ কি? বড়ই শক্ত কথা। তিনি আরো বলেন, দুঃখ-কষ্টই মানুষের জীবনকে অর্থ দেয়, ফলে দুঃখ-কষ্টকে ভয় পাবার কিছু নেই। এর থেকে পালিয়ে থাকারও কিছু নেই। তুমি সুপারম্যান হয়ে যাও। দুঃখ-কষ্টকে ফাইট করো তুমি, এতেই তোমার সকল সুখ নিহিত। হ্যাঁ, নিৎচা প্রকৃত অর্থেই মানুষকে সুপারম্যান হতে বলেছেন। তিনি Übermensch নামক শব্দটি তাঁর দর্শনে ব্যবহার করেন, যার প্রকৃত অর্থ কিন্তু সুপারম্যান। নিৎচা যদি টুলি বেগমকে দেখতে পেতেন তবে নিশ্চিতভাবে তিনি ‘Übermensch! Übermensch!’ বলে চেঁচিয়ে উঠতেন। কিন্তু তাই বলে কি দুঃখ কমে যায়? বুকের মাঝের ঘা কি শুকিয়ে যায়? 
 
মানব দুঃখ নিয়ে খুব সম্ভবত এই ধরার বুকে সবচেয়ে চমৎকার দর্শন দিয়ে গেছেন গৌতম বুদ্ধ। আরিফ রহমান ভাই তাঁর বহুল পঠিত ‘এটা আমার দর্শনের নোটখাতা নয়’ বইয়ে লিখেছেন, “বুদ্ধকে জানলে পৃথিবীতে এতো বিবাদ থাকে না, থাকে না এতো বিষাদ।”, কথাটি সত্য। বুদ্ধের কথা একটু শুনলেই বুঝতে পারবো কেন আরিফ রহমান ভাই কথাটি বলেছেন। 
 
বুদ্ধ বলেন, “জন্মে দুঃখ, নাশে দুঃখ, রোগ দুঃখ, মৃত্যু দুঃখময়। অপ্রিয় সংযোগ দুঃখময়, প্রিয়জনের বিয়োগ দুঃখময়। সকল কিছুই দুঃখময়।” কি, মনে হচ্ছে না বুঝি টুলি বেগমকে সামনে রেখে কথাগুলো বলছেন বুদ্ধ?
এখন শুনেন বুদ্ধ এই দুঃখের গ্যারাকল থেকে মুক্তির কি উপায় বলেছেন, “প্রিয় কিংবা অপ্রিয় কোনো কিছুতেই অনুরক্ত হয়ো না। কারণ প্রিয়বস্তুর অদর্শন এবং অপ্রিয় বস্তুর দর্শন উভয়ই দুঃখজনক। তাই প্রিয়ানুরাগী হয়ো না। প্রিয়বিচ্ছেদ দুঃখজনক। যাঁর প্রিয়-অপ্রিয় কিছুই নেই তাঁর কোনো বন্ধন থাকে না। প্রিয় থেকে শোকের উৎপত্তি হয়, প্রিয় থেকে ভয়ের উৎপত্তি হয়। যিনি প্রিয়াসক্তি থেকে উত্তীর্ণ শোক থাকে না, ভয় থাকবে কীভাবে? প্রেম থেকে, আসক্তি থেকে শোকের উৎপত্তি হয়। যিনি প্রেম, আসক্তি, কাম তৃষ্ণা থেকে উত্তীর্ণ তাঁর শোক থাকে না, ভয় থাকবে কীভাবে?” কতো সহজেই গৌতম কি অসাধারণ সুন্দর কথা বলেছেন!
 
আর দুঃখের সাথে খুব সম্ভবত বাস্তব জীবনে সবচাইতে বেশি ডিল করেছে নবীজি (সা.) স্বয়ং; সারাটা জীবন কি অসহ্য দুঃখই না সহ্য করে গেছেন নবীজি, আমরা সেটা জানলেও উপলব্ধি করি কি? জন্মের আগে বাবার মৃত্যু, জন্মের পর একে একে মা, দাদা, এরপর চাচার মৃত্যু। বিয়ে হলো খাদিজা (রা.) এর সাথে। প্রচণ্ড সুখে যাচ্ছিল তাঁর দিনকাল, যে সুখের স্বাদ তিনি আগে কখনো পান নি। কিন্তু সুখ বেশিদিন সহ্য হলো না। পর পর মারা গেল দুটি ছেলে সন্তান, জন্মের মাসখানিকের মধ্যেই। তিনি এবার আর কষ্টটি আর নিতে পারলেন না। চলে গেলেন হেরা গুহায়। গভীর ধ্যানে মগ্ন রইলেন। নিজের দুঃখ নিয়ে, মানুষের সামগ্রিক দুঃখ নিয়ে ভাবতে থাকলেন, ভাবতে থাকলেন তৎকালীন আরব সমাজ নিয়ে। ধ্যানে ডুবে রইলেন। এক সময় বোধিপ্রাপ্তি হলো তাঁর। তিনি কাঁপতে কাঁপতে বাসায় ফিরলেন। উনাকে আগলে ধরলেন প্রিয়তমা স্ত্রী খাদিজা, সব সময়ের মতো। সেই প্রিয়তমা স্ত্রীও তাঁর চোখের সামনের সমাজের বয়কটের মুখে কষ্ট পেয়ে পেয়ে মারা যায়। কবি জসিমউদ্দীন ‘কবর’ কবিতার পংক্তিগুলোয় যেন নবীজির জীবনের কথাই লিখে রেখেছেন-
 
“তারপর এই শূন্য জীবনে যত কাটিয়াছি পাড়ি
যেখানে যাহারে জড়ায়ে ধরেছি সেই চলে গেছে ছাড়ি।
শত কাফনের, শত কবরের অঙ্ক হৃদয়ে আঁকি,
গণিয়া গণিয়া ভুল করে গণি সারা দিনরাত জাগি।
এই মোর হাতে কোদাল ধরিয়া কঠিন মাটির তলে,
গড়িয়া দিয়াছি কতো সোনামুখ নাওয়ায়ে চোখে জলে।”
 
একদিন নবীজি দেখতে পেলেন কবরের কাছে বসে বুক চাপড়ে কাঁদছেন এক মহিলা। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি ব্যাপার?’ মহিলা বলল, ‘আমার ছেলে মারা গিয়েছে, এই তাঁর কবর।’ ‘তাই বলে এভাবে কাঁদছো তুমি?’ জিজ্ঞেস করলেন নবীজি। মহিলা রেগে ফুসে উঠলেন। চিৎকার করে উঠে বললেন, ‘তুমি এইসব বলার কে? হ্যাঁ? তোমার কয়জন মারা গেছে যে তুমি আমাকে এগুলো বলতে এসেছো?’
 
আফসোস, মহিলা জানতেন না তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি কষ্টের কি মহাপ্লাবনের মধ্যে দিয়েই না সাঁতরে এসেছেন ততদিনে! তিনি এই বাণী চিরকাল প্রচার করে এসেছেন যে, তোমারা সরাসরি সেই বিধাতার হয়ে যাও, সেই মহান সত্ত্বার সাথে একাত্ম হও, দেখবে দুঃখ চলে যাবে। খুব সম্ভবত পৃথিবীর বুকে তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি বলেছেন, খোদাকে ডাকার জন্য, খোদার কাছাকাছি চলে যাবার জন্য তুমি/আমি একাই যথেষ্ট; কোনো পুরোহিত, কোনো উপদেবতা, কোনো কিছুর প্রয়োজন নেই। সেই পরম অস্তিত্বের সামনে একজন রাজাধিরাজ ও একজন নিঃস্বের মূল্য সমান এবং তার মূল্যই বেশি যে সেই মহান সত্ত্বার সাথে মিলিত হতে পারবে। আর সেই মিলনের ফলে ঘুচে যাবে সকল অসুখ, অশান্তি, ক্লান্তি। 
 
টুলি বেগমের মতো আমরাও জীবনের নানান ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে যাই। সত্যি বলতে, দুঃখের কোনো তুলনা চলে না। কারণ দুঃখ আপেক্ষিক এক বিষয়, বড়ই সাবজেকটিভ এক জিনিস। জীবনে দুঃখ আছে বলে জীবন শেষ করে দিতে হবে? সুইসাইড কি আসলেই একটা সমাধান? একটি গুরুতর দার্শনিক সমস্যা? বলা কঠিন। সত্যি কঠিন। উত্তরটা একেকজনের জন্য একেকরকম। যতই ভাবি ততই মাথার ভেতরটা প্যাঁচ খায়। আমি অনেক সময়ই সেই প্যাঁচ ছুটানোর চেষ্টা খুব একটা করি না। প্যাঁচকে প্যাঁচের মতোই রেখে দেই। পৃথিবীকে বুঝার চেষ্টা করি। টুলি বেগমকে বুঝার চেষ্টা করি। টুলি বেগম ও আমার মাথার উপর রুপার থালার মতো বিষণ্ণ চাঁদের সৌন্দর্য বুঝার চেষ্টা করি। বুঝার চেষ্টা করি কেন আর্নেস্ট হেমিংওয়ে লিখে গেছেন, A man can be destroyed but cannot be defeated; কেন মানুষকে ধ্বংস করা গেলেও পরাজিত করা যায় না। বুঝার চেষ্টা করি। খুব করে বুঝার চেষ্টা করি।
 
~
২৭/০২/২০২৪, মঙ্গলবার।

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ