ধর্ষণ মূলত ক্ষমতা প্রদর্শনের একটি ফলাফল
আমার বাবা বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী। নানান কেইস আসে তাঁর কাছে। মাঝে মাঝে বাবাকে সেইসব কেইসের ড্রাফটে হেল্প করার সুবাদে নানান বিচিত্র ঘটনার ব্যাপারে জানতে পারি। যেমন, একটা কেইস এমন ছিল যেখানে অনেকদিন ধরে এক প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ আরেক প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষকে রেগুলার ধর্ষণ করে আসছে, পরে একদিন ধর্ষিত পুরুষটি ধর্ষক পুরুষকে হত্যা করে ফেলে। খুব ইন্টারেস্টিং তাই না? ঘটনা কিন্তু এই বাংলাদেশেরই। যখন এই ঘটনা সম্পর্কে ভাবছিলাম তখন একটু একটু করে বুঝতে পারি, এই ধর্ষণের ঘটনা, বা অন্য কোনো যৌন উৎপীড়নের ঘটনাকে শুধু জেন্ডারের আলাপ দিয়ে ব্যাখ্যা করলে চলবে না। এটিকে বুঝতে হলে আরও গভীরে যেতে হবে। আরেকটু বললে বিষয়টা ক্লিয়ার হবে।
আমার চেনা অনেক অনেক পুরুষ বন্ধু আছে যাদের সাথে ছোটবেলায় যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে। এই ক্ষেত্রে নিপীড়ক কখনো পুরুষ, কখনো আবার নারী। মাদ্রাসায় যেসব শিশু বলাৎকারের খবর আসে সেগুলো দেখেন, ভিক্টিম আসলে কে বা কারা। আবার শুনেছি, মৌমিতা দেবনাথের কেইসে, একজন নারী নাকি ওই গণধর্ষণের সময় তাঁর হাত চেপে ধরে রেখেছিল। হয়তো তথ্যটি ভুল, হয়তো ঠিক। কিন্তু যদি সত্যিও হয়ে থাকে তবে এতে অবাক হবার কিছু নেই।
ধর্ষণকে আমরা তখনই নির্মূল করতে পারবো যখন আমরা ধর্ষণ বা এই ধরনের অপরাধকে নারী-পুরুষের বাইনারি থেকে বের হয়ে দেখার চেষ্টা করবো। ধর্ষণ কখনোই যৌনতা মেটানোর খায়েশ থেকে সংগঠিত হয় না, হয় ক্ষমতা প্রদর্শনের একটি ফলাফল হিসেবে। আমার ক্ষমতা বেশি, তাই আমি ধর্ষণ করতে পারছি। এইখানে জেন্ডার বা যৌন চাহিদা আসলে মূল ইস্যু না, কার ক্ষমতা এখানে বেশি সেটা বড় ইস্যু। ফলে, ২০১২ সালের নির্ভয়া কেইস, ২০১৬ সালের তনুর কেইস, ২০১৮ সালের কাশ্মিরের শিশু আসিফার কেইস, বা এই ২০২৪ সালের মৌমিতার কেইস বা অন্য যেকোনো কেইসই উঠিয়ে দেখি না কেন, এর গোড়ায় গিয়ে দেখবো ধর্ষণ বা অন্য কোনো সেক্সুয়াল অফেন্স কখনোই লিঙ্গের উপর নির্ভর করে না, নির্ভর করে ক্ষমতা কাঠামো এবং ক্ষমতা প্রয়োগের উপর। সবই ওই ক্ষমতার খেলা। এখন এটি মাথায় রেখে শুরুতে যেসব কেসের কথা বলেছি সেগুলো বিশ্লেষণের চেষ্টা করেন তবেই কথাটি চট করে ধরে ফেলবেন।
প্রথমের কেইসটা দেখেন, এক পুরুষ আরেক পুরুষকে ধর্ষণ করলো, এর পেছনে গেলে দেখবেন ধর্ষকটি সামাজিকভাবে ধর্ষিতের চাইতে ক্ষমতাবান। বা ছোটবেলায় আমার পরিচিত বন্ধুরা যে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছি সেইখানে নিপীড়ক আমাদের চেয়ে বয়সে বড়, ফলে বেশি শক্তিশালী এবং ক্ষমতবান, আর তাঁদের মধ্যে পুরুষ যেমন আছে, নারীও সেইভাবে আছে। মাদ্রাসার যেসব কেস আমাদের সামনে আসে ওইখানে তো ক্ষমতার প্রয়োগ আমরা দেখিই স্পষ্টভাবে। অতএব, ধর্ষক মানেই পুরুষ, ধর্ষিত মানেই নারী, এই ধারণা ভুল। খেয়াল করবেন, যখন কোথাও যুদ্ধ হয়, তখন জয়ী বাহিনীরা পরাজিতদের নারীদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে, ধর্ষণের মেলা লেগে যায় একদম। কেন এটা হয়? যুদ্ধের সময় কি লিবিডো বেড়ে যায় কোনো কারণে? মোটেই না। জয়ী বাহিনী আসলে ধর্ষণের মাধ্যমে তাঁদের নতুন পাওয়া ক্ষমতাকে প্রয়োগ করে, তাঁদের ডমিনেন্স দেখায় অপর পক্ষের উপর। "পাতাললোক" সিরিজের একটা এপিসোড আছে যেখানে একটি বীভৎস গণধর্ষণের দৃশ্য দেখানো হয়। একটু মনোযোগ দিয়ে দেখলেই বুঝা যায় পুরো ব্যাপারটা আসলে কেবল মাত্র ক্ষমতা প্রয়োগের এক হাতিয়ার বৈ আর কিছু নয়। রেপ নিয়ে একাডেমিক যেসব আলাপ হয়েছে, সেইসব ঘেঁটে দেখেন, সবখানে কমবেশি এই কথাটি বলা আছে।
কিন্তু এইযে পুরুষদের দোষারোপ করা হচ্ছে সেটা কেন? কেন পুরুষতন্ত্রকে দোষ দেয়া হচ্ছে? কারণ, আমাদের সমাজে পুরুষকে করা হয়েছে ক্ষমতাবান। তাঁরা অভিভাবক, তাঁরা নীতিনির্ধারক। তাঁরা যেভাবে যেভাবে বলবে, সেইভাবে সেইভাবে একজন মেয়েকে চলতে হবে। এই হচ্ছে কেবল ক্ষমতার ব্যবহার আর কিছু না। শুরু থেকে একটা স্পেসিফিক জেন্ডারকে এতোটা ক্ষমতা দিয়ে রাখলে যা হবার তাই হয়েছে। কোনো কিছু পছন্দ না হলে ক্ষমতার প্রদর্শন তাঁরা করছে। ২০১৮ সালের নির্ভয়া কেসের সময় একজন ধর্ষক তো সরলভাবে বলেছে, 'মেয়েটা কেমন কথা রাতের এই সময় বয়ফ্রেন্ডের সাথে এইভাবে ঘুরবে? রেপ করেছি উচিত হয়েছে।' এইখানেও দেখেন, কেবল মাত্র ক্ষমতার প্রয়োগ হয়েছে: তুমি কীভাবে এইটা করতে পারো, দাড়াও মজা দেখাচ্ছি, খুব রং লেগেছে শরীরে তাই না? মজার কথা যদি সমাজে কোনোভাবে এই জেন্ডার পলিটিক্স উল্টে যায়, যদি নারীরা ক্ষমতাবান হয়ে পড়ে তাহলেও অনেকটা সেইম কেস হবে। হয়তো আজকের দিনের মতো এই বর্বর ধর্ষণ হবে না, কিন্তু নতুন কোনো ধরনের বর্বরতার জন্ম ঠিকই হবে।
ভারতের রাজস্থানের একটা কেইসের কথা না বললেই নয়। ঘটনাটি এমন: তেরো বছরের ছেলে তাঁর নয় বছরের বোনের সাথে ঘুমিয়ে ছিল, এরপর সুযোগ বুঝে ছেলেটা তাঁর বোনকে ধর্ষণ করে। ধর্ষণের পর বোনটি বলে, সে সবকিছু বলে দিবে সবাইকে। এতে ভাইটি তখন গলা টিপে বোনটিকে হত্যা করে, এরপর মাকে ডেকে আনে। মা এসে দেখে বোন এখনো মরে নাই, শ্বাসপ্রশ্বাস চলছে। এর মধ্যে তাঁর অন্য দুই বোনও চলে আসে। সব শুনে সবাই এই সিদ্ধান্তে আসে যে, ওই বোনটাকে গলা টিপেই হত্যা করা হবে, আর সেটাই করা হয় এবং পুলিশকে বলা হয় সাপের কামড় খেয়ে নয় বছরের মেয়েটি মারা গেছে। কিন্তু পুলিশের এতে সন্দেহ জাগে এবং পরে যখন সব ঘটনা বের হয় তখন সেই মা আর দুই বড় বোন বলে: পরিবারের একমাত্র ছেলে জেলে যাক, এটা তো হতে দেয়া যায় না; তাই তাঁরা ঘটনাটি ঢেকে রেখেছিল। পুরো ঘটনাটা একটু ভালো করে দেখেন দেখি, এইখানে কি আপনারা জেন্ডারের ইস্যু দেখতে পাচ্ছেন? এই ঘটনায় পুরুষ যেমন পাপী, নারীও তেমন পাপী। ঝামেলাটা আসলে কথায়? ক্ষমতা কাঠামোতে। ওই পরিবারের নারীরা পর্যন্ত জানে, এই সমাজে পুরুষের কি ক্ষমতা। একটা মেয়ে শিশু ধর্ষণের পর মারা গেছে তো কি হয়েছে, পুরুষের কোনো ক্ষতি হওয়া যাবে না। বিষয়টা এখানে জেন্ডারের না, ক্ষমতার।
ক্ষমতা মানুষকে কলুষিত করে বাজেভাবে, যদিও সব সময় না। মিশেল ফুকো আমাদের দেখিয়েছেন ক্ষমতা সব সময় যে খারাপ তা নয়। ফুকোর মতে, ক্ষমতা নিছক দমনমূলক কোনো কিছু নয় বরং এটি বেশ প্রোডাক্টিভ এক জিনিস। চাইলে এই দিয়ে জ্ঞান, সামাজিক নিয়ম এবং ব্যক্তিগত আচরণকে একটা আকার দেয়া যায়, যদি ঠিকমতো ক্ষমতার প্রয়োগটা করা যায়। কিন্তু সেটা আরেকদিনের আলাপ। আপাতত আমাদের এইটা বুঝতে হবে, ধর্ষণ কোনো জেন্ডার ইস্যু নয়, বরং ক্ষমতার ইস্যু। এইখানে জেন্ডারের আলাদা কোনো ভূমিকা নেই। এই সহজ জিনিস আগে বুঝলে এরপর ধর্ষণের প্রতিরোধ-প্রতিকার নিয়ে আলাপ করা যাবে। এর আগে না।
~
১৭-০৮-২০২৪
মালিবাগ চৌধুরীপাড়া, ঢাকা।
Painting: "The Rape of the Sabine Women" by Nicolas Poussin (1637-1638)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন