হিটলারের পাগলা ফ্যান


আমার সাথে একজন হিটলারের ভক্তের পরিচয় আছে। সে হলো অ্যাডলফ হিটলারের পাগলা ফ্যান। হিটলারের কোনো কুকর্মকে সে মানতে নারাজ। কিছু হলেই বলে, আরে এইটা মনে ওইটা না, ওইটা মানে এইটা না ইত্যাদি (মাঝে মাঝে তো বলেও ফেলে হিটলার নাকি ফ্যাসিবাদীও না, ওইসব নাকি "হিটলার হেটার্সদের" অপব্যাখ্যা!)

তার সাথে মাঝে মাঝেই কথা হয়ে থাকে। হিটলারের সমর্থক হলেও সে মানুষ ভালো। তো একদিন তার সাথে কথায় কথায় হিটলারের প্রসঙ্গ চলে আসে। এবং বরাবরের মতোই হিটলারের গুনগান গাইতে থাকে সে। সেইদিন আমার কী হলো জানি না, কিন্তু তার এই অন্ধ সমর্থন সহ্য করতে পারলাম না। শুরু করলাম কঠিন বাক্য যুদ্ধ!

যুদ্ধের এক পর্যায়ে দেখায় দিলাম হিটলার কত বড়ো গণহত্যাকারী। হলোকাস্টে যে ৬-১১ লাখ ইহুদীদের হত্যা করা হয়েছিল এবং সেইটা যে খুবই বর্বর এবং অমানবিক ছিল সেইটাও বললাম, ব্যাখ্যা করলাম তার কাছে। দেখি, বেচারা ভালো ঝামেলায় পড়লো। ব্যাপারটা অস্বীকারও করতে পারছে না, আবার নিতেও পারছে না। তখন সে একটা অদ্ভুত কাণ্ড করলো।

"আরে ভাই সে আসলে এমন না, আরে বুঝো না সে মানুষ ভালো। সে যে একজন পশুপ্রেমী ছিল সেইটা তো জানো। তুমিই বলো, যে একজন পশুপ্রেমী, নিষ্পাপ পশুদের ভালোবাসে, সে কি কখনো এতো মানুষের হত্যা করতে পারে, বলো?"

আমি ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। বললাম, "তুমি একটু পানি খাও।"

জানেন এইখানে কোনো কুযুক্তির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে? একটু ভেবে দেখেন তো।

উপরের ঘটনায় বর্ণিত কুযুক্তির নাম "Moving the Goalposts Fallacy", বাংলায় যেটার নাম "লক্ষ্য পরিবর্তন কুযুক্তি"। যুক্তিবিদ্যার অন্যতম কুযুক্তি এটি।

মুভিং দ্যা গোলপোস্ট হচ্ছে একটি ইনফরমাল লজিক্যাল ফ্যালাসি। বিতর্ক বা আলোচনার মূলবিষয়বস্তু থেকে সরে গিয়ে নতুন আরেকটি বিষয় নিয়ে বিতর্কের সুচনা করা, বা বিতর্কের মধ্যেই বিতর্কের নিয়ম পরিবর্তনের চেষ্টাকে লক্ষ্য পরিবর্তন কুযুক্তি বা কৌশল বলা হয়।

ধরুন, দুটি দলের মধ্যে ফুটবল খেলা হচ্ছে। একটি দলের নাম "ডলফিন" অপরটির নাম "ছাগল"। খেলায় ডলফিন দল একের পর এক গোল করছে। কিন্তু ছাগল দল কোনোই গোল করতে পারছে না। তখন ছাগল দল একটি কাজ করলো। তারা তাদের প্রান্তে একটি নতুন গোলপোস্ট তৈরি করলো। ওই নতুন গোলপোস্টটিকে ডলফিন দলের গোলপোস্ট হিসেবে দাবি করলো এবং একের পর এক গোল দিতে শুরু করলো ওই গোলপোস্টে। এবং নতুন গোলপোস্টটি যেহেতু তাদের প্রান্তে, তাই ইচ্ছে মত গোল করতে থাকলো। কিন্তু একই নিয়ম বিপরীতপক্ষের জন্য প্রযোজ্য করলো না। মানে, ডলফিন তাদের দিকে গোলপোস্ট বানিয়ে গোল দিতে পারবে না। এই সুবিধাটি শুধুমাত্র তাদের জন্যেই প্রযোজ্য।

খেলার মাঝখানে এই নতুন নিয়ম আরোপ করে, নতুন লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ করে, সুবিধাজনক অবস্থানে গোলপোস্ট বানিয়ে গোল দেয়া, এটি কোন অবস্থাতেই ন্যায়সঙ্গত নয়। (এইসব যুক্তি কেবল মূর্খ মানুষদেরই তর্কে জেতার কৌশল)

উপরের ঘটনায় হিটলার ফ্যান যখন দেখলো সে কোনোভাবেই হিটলারের গণহত্যাকে ডিফেন্ড করতে পারছে না তখন সে সুবিধামত নতুন একটি বিষয় নিয়ে এসে গণহত্যাকে জাস্টিফাই করলো। হিটলার পশুপ্রেমী, খুবই ভালো কথা। কিন্তু তাই বলে এইটা কোনোভাবেই প্রমাণ হয়ে যায় না যে সে গণহত্যা করেনি। গণহত্যার সপক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ আছে। সে পশুপ্রেমী হোক আর যাই হোক এতে কিছু যায় আসে না। এইযে সম্পূর্ণ নতুন একটি বিষয় এনে পূর্বের বিষয়কে জাস্টিফাই করার চেষ্টা, এইটাই Moving the Goalposts Fallacy।

একটা মানুষের মধ্যে ভালো খারাপ দুই গুণই আছে। কিন্তু ভালো গুণ আছে বলেই তার খারাপ কাজ মাফ হয়ে যাবে এমনটা না। যে আসামীকে ফাঁসি দেওয়া হয় তার নিশ্চয় অনেক ভালো কাজ আছে। কিন্তু কোর্ট সেই ভালো কাজ দেখে বিচার করে না।

এমন কুযুক্তি আমাদের সমাজে বহু আছে। মুক্ত চিন্তার চর্চার অভাবে আমরা প্রায় সময়ই তা ধরতে পারি না।

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ