খড়ের মানুষকে হারিয়ে দেওয়া



নির্মল দাদা আমাদের পাশের বাসায় থাকেন। পুরো নাম নির্মল ঘোষ। বয়স ২৬। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স পাশ করে বেশ বড় একটি কোম্পানিতে চাকুরি করছে। সে ছিল হিন্দু  ধর্মাবলম্বী। ছিলেন বলছি কেননা সপ্তাহখানিক আগে সে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে। এটি নিয়ে তার বাসায় বিশাল হইচই। প্রায় সময়েই বাসা থেকে চিল্লাচিল্লির আওয়াজ আসে। 

একদিন ব্যাপারটা বেশ খারাপ হয়ে পড়ে। খুব চিল্লাচিল্লি শুনা যায়।  এক পর্যায়ে দেখি নির্মলদা ঘর থেকে বের হয়ে যায়। দাদার মা পেছন থেকে তাকে ডাকতে ডাকতে কাঁদতে কাঁদতে বের হয়ে আসে। দেখি দরজা দিয়ে নির্মলদার বাবাও বের হয়ে আসে, বলে, "যাও যাও ওই মেয়েটার কাছে যাও। ওর জন্যই তো মুসলমান হইসো যাতে ওকে বিয়ে করতে পারো! একটাবারের জন্য নিজের মা-বাপের কথা ভাবো নাই? এই সমাজের কথা ভাবো নাই? একটা মেয়ের জন্য সব ছেড়ে দিলা!"

শুনলাম দাদা বলল, "আব্বা আমি কেন মুসলিম হইসি সেটা একদম তোমাকে ব্যাখ্যা করে বলসি। আমি কুরআন-হাদিস পড়েছি। আমার এই ধর্ম অনেক ভালো লেগেছে। কতবার এক কথা বলবো তোমাকে!"

"এত বলতে হবে না তোমার। বয়স তো কম হয় নাই। সব ঠিকই বুঝি।"

জানেন এইখানে নির্মলদার বাবা একটি কুযুক্তি দিয়েছে। হ্যাঁ একটা ফ্যালাসি। এই ফ্যালাসি বেশ বিখ্যাত এক ফ্যালাসি, এর নাম "Strawman Fallacy", বাংলায় "খড়ের মানুষ কুযুক্তি"। 



 বিপক্ষের তার্কিক আসলে যা বলেনই নি, সেরকম কিছু তিনি বলেছেন দাবী করে সেই বক্তব্যকে যুক্তি দিয়ে পরাজিত করার যুক্তিকে স্ট্রম্যান ফ্যালাসি বা খড়ের মানুষ বানিয়ে তার সাথে যুদ্ধ করার কুযুক্তি বলে। এটি সাধারণত একটি ইনফরমাল লজিক্যাল ফ্যালাসি। একটি উদাহরণ দেই। 

ধরেন 'ক' নামক ব্যক্তি নারীবাদের পক্ষে কথা বলছেন, বলছেন কেন মেয়েদের শিক্ষিত হতে হবে, কেন তাদেরও সম-মর্যাদা দিতে হবে। এখন 'খ' নামক ব্যক্তি বলল যে, 'ক' নামক ব্যক্তি আসলে লুইচ্চা, সে মেয়েদের উলঙ্গ দেখতে চায়। তাই নারীবাদের পক্ষে কথা বলে। নারীবাদ প্রতিষ্ঠিত হলে নাকি মেয়েরা জামাকাপড় পড়া ছেড়ে দিবে, ওই লোক নাকি সেটাই চায় ইত্যাদি। খেয়াল করে দেখুন, 'ক' ব্যক্তি একবারও এমনটা বলেননি। লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে,'খ' হয়তো মনে করেন নারীবাদ প্রতিষ্ঠা হলে খারাপ হবে, তাই 'ক' ব্যক্তি কী বলছে তার মধ্যে না গিয়ে তিনি নিজেই বিপক্ষের বক্তার একটি বানানো আর্গুমেন্ট তৈরি করলেন, এবং সেটাকে হারিয়ে দিলেন। একজন যেমন খড় দিয়ে মানুষ বানিয়ে তার সাথে মল্লযুদ্ধ করে যুদ্ধ জয় করার ভান ধরে, খুব বীরত্ব দেখানো হয়েছে বলে সবাইকে বোঝাতে চায়, ঠিক তেমনি, বক্তা 'ক' যা আসলে বলেনই নি, সেই আর্গুমেন্ট বানিয়ে উনি নিজেই যুদ্ধে জয়লাভ করে বসলেন। নারীবাদের সাথে মেয়েদের উলঙ্গ হবার কোনোই সম্পর্ক নেই। এরকম যুক্তি উপস্থাপনের চেষ্টাকে খড়ের মানুষ হারানো কুযুক্তি বা ফ্যালাসি বলা হয়। 



উপররে ঘটনা খেয়াল করুন। নির্মলদা কিন্তু একবারও বলেন নি তিনি কোনো মেয়ের জন্য তার পূর্বের ধর্ম ত্যাগ করেছেন। তিনি অনেকবার বলেছেন, তিনি কুরআন-হাদিস পড়েছেন এবং উনার তা ভালো লেগেছে তাই তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। কিন্তু তার বাবা ধরেই নিচ্ছেন যে একজন মেয়ের জন্য তিনি মুসলিম হয়েছেন। এবং সেটিকে যুক্তি হিসেবে ধরে নিয়ে প্রতিনিয়ত নির্মলদাকে হেয় প্রতিপন্ন করছেন। এমন কিছু করাকে স্ট্রম্যান ফ্যালাসি বলে। 

লেখাটি শেষ করছি নির্মলদার মাধ্যমেই। তার বাবা যখন বারবার একই কথা বলতে লাগলেন তখন নির্মলদা বললেন, "শুনেন আব্বা, ইসলামের মধ্যে অনেক ভাগ আছে। আমি সুন্নি মুসলমান। আর নুপুর আহমদি মুসলমান। একজন আহমদি মুসলমান কখনই আহমদিদের বাইরে বিয়ে করতে পারে না। তাই একটা কথা বলার আগে জেনে বুঝে কথা বলবেন।" 



এই বলে নির্মলদা বাসা থেকে বের হয়ে যান। নির্মলদার বাবা চুপ করে দাড়িয়ে থাকেন দরজার কাছে, দাদার মা শব্দ করে কাঁদতে থাকেন। 

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ