আধুনিক সমাজ ও আমাদের দায়িত্ববোধ



জন্ম এবং মৃত্যু, এই দুয়ের মাঝে একটি নির্দিষ্ট সময় আমাদের সকলকে একটি নির্দিষ্ট গ্রহে, একটি নির্দিষ্ট দেশে, একটি নির্দিষ্ট সমাজে বসবাস করতে হয়। এবং একটি দেশে, একটি সমাজে আমরা একা বেঁচে থাকতে পারি না। আমাদের সাহায্য লাগে, দশজনের সহযোগিতা লাগে। এমনটাই হয়ে এসেছে। যখন আমরা একদম ছোট তখন আমরা সাহায্য নিয়েছি আমাদের মা-বাবার কাছ থেকে। তারপর আমরা একটু বড়ো হই। স্কুলে যাই। তখন আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে আমাদের শিক্ষক ও আমাদের সহপাঠী। শরীর খারাপ করলে আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন চিকিৎসক। তারপর আরও বড়ো হয়ে যখন আমাদের একটি আলাদা পরিবার হয়, স্ত্রী হয়, সন্তান হয়, সংসার হয়, তখন সংসার সামলানোর জন্যও আমাদের অসংখ্য মানুষের সাহায্য লাগে। 

এইযে এতক্ষণ ধরে আমি কেবল "সাহায্য" শব্দটির প্রয়োগ করে গেলাম, তা শুধু আমাদের জীবনের একটি দিককে তুলে ধরে। আমরা সাহায্য নেই ঠিকই কিন্তু একই সাথে আমাদের পালন করতে হয় নির্দিষ্ট দায়িত্ব। নিজের দায়িত্ব পূরণ না করে সত্যিকার অর্থে সাহায্য পাওয়া যায় না। 

যেমন, আমাদের মা-বাবা, তারা আমাদের একদম নিঃস্বার্থভাবে করেন ঠিকই, কিন্তু আমাদেরও তাদের প্রতি অনেক দায়িত্ব পালন করতে হয়। আবার এইযে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাই আমরা, সেইখানে টিকে থাকতে, শিক্ষক এবং অন্যান্যদের সাহায্য পেতে হলেও আমাদের নিজ নিজ দায়িত্ব যেমন ভালো করে পড়াশোনা করা, নিয়ম মেনে চলা, অন্যদের সাথে ভালো ব্যবহার করা ইত্যাদি পালন করতে হয়। আবার সংসার চালাবার জন্য আমাদের চাকুরী, ব্যবসা ইত্যাদি করতে হয়, এবং তবে গিয়েই কৃষকের কষ্টের ফসল আমরা নিজ ঘরে তুলতে পারি। 

বর্তমান আধুনিক সমাজ অত্যন্ত জটিল দেখে আমাদের অনেকের মাঝে এই দায়িত্ববোধের উন্মেষ ঘটে না। অনেকে বুঝেই না যে একটি সমাজে কিছু না দিলে, কিছু পাওয়া যায় না।  ছোটবেলা থেকে যখন এক শিশু দেখে সে চাইতেই খাবার পাচ্ছে, গায়ে পড়ার কাপড় পাচ্ছে, একটু বায়না ধরলেই খেলনা পাচ্ছে তখন প্রায়শই তার মধ্যে দায়িত্ববোধের উন্মেষ ঘটে না (যদি মা-বাবা শিশুকে ছোটবেলা থেকে অল্প অল্প দায়িত্ব নিতে শিখায় তবে অবশ্য শিশুরা বুঝে যায়)। আবার অনেকে বড়ো হয়ে দেখে ভিন্ন উপায়, খুব কষ্ট না করেও অন্যের সাহায্য পাওয়া যায়। তখন তারা নিজ দায়িত্বে না গিয়ে শর্টকাট খুঁজে। এমন মানুষের সংখ্যা অপ্রতুল নয়; বিশেষ করে সরকারী দপ্তরে এবং রাজনীতির ময়দানে এমন উদাহরণ প্রচুর আছে। 


আদিমকলে সমাজ যখন কৃষিভিত্তক ছিল, বা আরো আগে মানুষেরা যখন শিকার করে খেত, তখন তাদের দায়িত্ববোধ ছিল প্রবল। কেননা তারা জানত, আজকে যদি ঠিকমতো শিকার তারা না করে বা আজকে লাঙল যদি ঠিক মত না দেয়া হয় তবে পেট শূন্য থাকবে। তারা জানতো মাদার নেচার কাউকেই ছাড় দেয় না; প্রকৃতির কাছে সকলেই সমান। কিন্তু বর্তমান আধুনিক সমাজ আজ অনেককেই বুঝতে দেয় না যে দায়িত্ব কী জিনিস। ফলে সমাজে প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে ডজন ডজন অমানুষ। বর্তমানে যে একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে তার একটি কারণ হলো দায়িত্বহীনতা। একটি সমাজকে টিকিয়ে রাখতে হলে মানুষকে মানুষের জন্য এগিয়ে আসতে হবে, ক্ষতি করা তো অনেক পরের বিষয়! মানুষের দায়িত্বহীনতা আজ কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে তা আজকের এই ধর্ষণের উৎসব দেখেই বুঝা যায়। 



আদিমকালে মানুষ দায়িত্ব পালনে কঠোর ছিল কিন্তু তাদের বলা হয় অসভ্য, আজ তার উল্টো দিকটা দেখা যায়, মানুষ চায় দায়িত্ব থেকে পালাতে, আর আমরা নাকি আধুনিক সভ্য মানুষ, আমরা নাকি সভ্য সমাজে বাস করি। এর চেয়ে আর বড়ো কোনো প্রহসন কি কিছু হতে পারে? 



মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ