ছোটগল্প ও রবীন্দ্রনাথ: সংক্ষিপ্ত পাঠ
১৮৭৪ সালের কোনো একদিন। "ভারতী" পত্রিকায় এক কিশোর লেখকের গল্প প্রকাশিত হয়েছে। ওই করুণরসাশ্রিত, ভাবাকুল কাহিনীর নাম "ভিখারিণী"। লেখকের নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। লেখকের প্রথম ছোটগল্প এটি। বলাই বাহুল্য, রবীন্দ্রনাথ তখনও "রবীন্দ্রনাথ" হয়ে উঠেনি। গল্পটি তাই নিতান্তই এক কিশোর লেখকের অপরিণত রচনা বললে ভুল বলা হবে না।
এরপর চৌদ্দ বছর কেটে যায়। লেখক নানান কিছু লেখেন কিন্তু ছোটগল্প তার বের হয়না এই সময়ে। প্রথম ছোটগল্প রচনার পর লেখক বুঝতে পেরেছিলেন যে রচনাটি সার্থক হয়নি। তারপর, একে একে প্রকাশিত হয় তার দুটি গল্প, "ঘাটের কথা" ও "রাজপথের কথা"। নিঃসন্দেহে কাহিনী পরিপক্কতা পেয়েছে, ক্ষমতার স্ফুরণ হয়েছে ঠিকই কিন্তু তখনো গল্প লেখার হাত তার অপটু। রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পেরেছিলেন তার ছোটগল্পের সীমাবদ্ধতাগুলো। তাই আবারো দীর্ঘদিনের বিরতি।
১৮৯১ সালের মে মাস। প্রকাশিত হতে শুরু করলো কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্যের সম্পাদনায় "হিতবাদী" পত্রিকা। এই পত্রিকায় একে একে প্রকাশিত হতে থাকে অসামান্য সব ছোটগল্প: পোস্টমাস্টার, দেনাপাওনা, গিন্নি, ব্যবধান, রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা ও তারাপ্রসন্নের কীর্তি। এতদিনে বাংলা ছোটগল্পে এক শিল্পীর আবির্ভাব হলো। এই শিল্পী সচেতন, তিনি সযত্নে লুকিয়ে রেখেছেন তাঁর কৌশল। যথার্থ শিল্প এমনি হয়ে থাকে। "হিতবদী" পত্রিকায় গল্পগুলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিণত গদ্যেরই উদাহরণ। বঙ্কিমচন্দ্রের গদ্য থেকে তার গদ্য আলাদা, স্বতন্ত্র। হঠাৎ করে এমন পরিবর্তনের কারণ কী? ১৯০২ সালের ২ রা মে'র এক চিঠিতে এর কারণ খুঁজে পাওয়া যায়। তিনি লিখেছিলেন, "জমিদারি দেখা উপলক্ষে নানারকমের লোকের সঙ্গে মেশার সুযোগ হয় এবং সেই থেকেই আমার গল্প লেখার শুরু।" আর এইভাবেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্পের প্রবাহ অর্গলমুক্ত হলো।
রবীন্দ্র ছোটগল্প ভাবপ্রধান, ঘটনাপ্রধান নয়। সেইসাথে গল্পের বিষয় অত্যন্ত বৈচিত্রময়। এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ অদ্বিতীয়। তাঁর গল্পের পটভূমি কখনো শহর, কখনো বা গ্রাম। গল্পগুলোতে প্রকৃতি কখনো বা শান্ত, কখনো নির্মম। তাঁর গল্পে বর্তমান জীবনের পরিচিত আবহাওয়া পাওয়া যায়, পাওয়া যায় সুদূর অতীতের রহস্যঘন আবরণ, থাকে অতিপ্রাকৃতের শিহরণ। কোনো কোনো সময় গল্পের বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে মায়ের প্রতি ভালোবাসা, কখনো বা প্রভুর প্রতি আনুগত্য, কখনো বা ভ্রাতৃস্নেহ। কখনো তার বিষয় অপূর্ণ প্রেম, কখনো বা কোমল মধুর প্রেম, কখনো বা প্রেমের জটিল সর্পিল নিষ্ঠুর রূপ। রবীন্দ্র ছোটগল্পের চরিত্রশালায় আছে রাজরানী, জমিদার, দরিদ্র কৃষক, হতভাগিনী বধূ, নিষ্টুর পুরুষ, অসহায় শিশু ইত্যাদি, অর্থাৎ সমাজের নানান স্তরের মানুষ।
রবীন্দ্র সাহিত্য নিয়ে একটি প্রচলিত অভিযোগ হচ্ছে, তা গণমানুষের জীবনকে খুব একটা ধারণ করতে পারেননি। "ঐকতান" কবিতায় তিনি নিজেই এই স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। তার ছোটগল্পও পুরোপুরিভাবে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের জীবনকে ছুঁতে পারেনি। কিন্তু বাঙালী রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প সাদরে গ্রহণ করেছে এবং তাঁর লেখায় জীবনের রূপকে স্পষ্টভাবে এবং গভীরভাবে দেখেছে। নিঃসন্দেহে তাই বলা যায়, বাংলা ছোটগল্প এবং রবীন্দ্রনাথকে কোনোভাবেই আলাদা করা যাবে না।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন