রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের ও আজকের নারী সমাজ
বিংশ শতাব্দির শুরু হওয়ার দুই দশক আগে
এই ভারত উপমহাদেশে এক নারীর জন্ম হয়েছিল যিনি অনেকটা নিজ হাতেই সেই সময়কার নারী সমাজকে
এক অন্ধকার কূপ থেকে বের করে এনেছিলেন, যদি এটা অত্যুক্তি হয়ে থাকে তবে বলবো, তিনি
গোটা পশ্চাদপদ নারী সমাজকে অন্ধকার কূপ থেকে অর্থাৎ, অশিক্ষা থেকে, কঠোর পর্দাপ্রথা
থেকে, হীনমন্যতা থেকে, সমাজের ক্লিশে চিন্তাধারা থেকে, নোংরা পুরুষতন্ত্র থেকে বের
হবার পথ দেখিয়েছিলেন এবং প্রথমবার এই বাংলার বুকে নারীবাদী আন্দোলনের সূচনা করে গিয়েছেন।
সেই মানুষটির নাম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ
ভারতে, রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে, লেখাপড়ায় পিছিয়ে-থাকা একটি রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে।
এমন একটি পরিবার থেকে উঠে এসে, যে পরিবারে কেবল পুরুষদের সামনে নয়, পাঁচ বছর বয়স থেকে
অপরিচিত মহিলাদের সামনেও পর্দা করতে হতো, এমন একজনের শিক্ষিত হওয়া, এবং এর চেয়েও বড়
কথা, নারীবাদী হওয়া একটি বিস্ময়ের ব্যাপার। এমন একটি পরিবার থেকে উঠে এসে মতিচূর, অবরোধবাসিনী, পদ্মরাগ, সুলতানাজ ড্রিম
এর মত গ্রন্থ রচনা করা আশ্চর্যের বিষয়। কিন্তু আসল কথা, তিনি পেরেছিলেন, পেরেছিলেন
নোংরা পুরুষতন্ত্রের শিকল থেকে নিজেকে বের করে এনে নারীকে সেই আসন ফেরত দিতে যা পুরুষতান্ত্রিক
সমাজ নারীদের থেকে ছিনিয়ে নিয়ে রেখেছিল।
বেগম রোকেয়ার সময় নারীরা ছিল পরাধীন।
তাঁদের জীবনের লক্ষ্য পুরুষরা ঠিক করে দিত। তাঁদের নিজেদের শখ থাকলেও তা পূরণ করার
কোনোই উপায় ছিল না। পড়াশোনা করা ছিল নারীদের কাছে এক বিলাসিতার নাম। নারীরা পড়াশোনা
করে করবে কী? তাঁদের কাজই তো হল কাজ থেকে বাসায় স্বামী ফিরলে তাঁর সেবা করা, বাদীদের
মত ঘর-সংসারের কাজ করা, বছর বছর সন্তান উৎপাদন করা এবং সেসকল সন্তানদের একলা হাতে মানুষ
করা। নারীদের কাজে পুরুষদের কোনো অংশগ্রহণ ছিল না এবং একজন নারী যে একজন পুরুষের মতই
কাজ করতে পারে তা কল্পনাই করা যেত না সেই সময়। একজন নারী হবে ম্যাজিস্ট্রেট! একজন নারী
হবে বিমানচালক! একজন নারী দাপ্তরিক কাজ করবে! সেই সময় এমন কিছু স্বপ্নে দেখাও পাপ ছিল!
একজন নারী সব সময় পুরুষের নিচে থাকবে, পুরুষ নারীদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ; এই ধারণা খুবই স্বাভাবিক
এক ব্যাপার ছিল সেই সময়। কিন্তু হ্যাঁ, নারীদের যে একেবারেই কোনো মর্যাদা ছিল না তা
নয়। একজন মা হিসেবে, স্নেহের বোন হিসেবে, কারো কারো কাছে ভালবাসার বউ হিসেবে সম্মান
বা মর্যাদা পেত একজন নারী। কিন্তু তাকে একজন মা অথবা বোন অথবা স্ত্রী অথবা দাদী অথবা
নানী থেকে বেশি কিছু ধরা হতো না। এবং বেশ কিছু পরিবার, বিশেষ করে মুসলিম পরিবার নারীদের
অধিক “সম্মান” দিতে গিয়ে তাঁদের করে রাখত অবরোধবাসিনী।
রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন
বর্তমান সময়ের দিক যদি তাকাই তবে নারীদের পারিবারিক এবং সামাজিক অবস্থানে এসেছে ব্যাপক এবং বৈপ্লবিক পরিবর্তন। নারীরা এখন পুরুষদের সাথেই কাজ করতে পারে। তাঁরাও হতে পারে ম্যাজিস্ট্রেট, বিচারপতি, বিমানচালক! তাঁদের কর্মক্ষেত্রের পরিধি অনেক বর্ধিত হয়েছে। কিন্তু যদি এই প্রশ্নে আসি, তাঁরা কী সত্যিই পুরুষদের সমান হতে পেরেছে? দুঃখজনক হলেও সত্যেও এই সময়ে এসেও এই সমাজ নারী এবং পুরুষের মাঝে একটি পার্থক্য তৈরি হয়ে আছে, যদিও সেই পার্থক্য বেগম রোকেয়ার সময় থেকে বেশ কম। বর্তমান নারী অনেক স্বাধীনতা পেলেও নিপতিত হয়েছে নিরাপত্তাজনিত সমস্যায়। একজন নারী কাজে যায় ঠিকই কিন্তু সেই কর্মক্ষেত্রে তাঁর নিরাপত্তা দেয়া অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হচ্ছে না। বাসে, ট্রেনে, অফিসে, আদালতে এখন নারীরা নানান প্রকার হয়রানির শিকার হচ্ছে। তাঁরা কাজে যাচ্ছে ঠিকই কিন্তু অনেক সময় দেখা যাচ্ছে কর্মক্ষেত্রে কেবলমাত্র নারী হওয়ার জন্য তাঁদের বেতন কমিয়ে দেয়া হচ্ছে, পুরুষের সমপরিমাণ কাজ করার পরও তাঁরা কম বেতন পাচ্ছে। তারপর, বাসার কাজ এখন প্রায় সবটুকু নারীদের করতে হয়, ঘরের কাজ যেন বিধাতা শুধুমাত্র নারীর জন্য রেখে দিয়েছিলেন! একজন নারীকে প্রতিষ্ঠিত হতে হলে যে পরিমাণ কষ্ট এবং সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, পুরুষদের কিন্তু সেই একই কষ্ট এবং সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যেতে হয় না আজও। অনেক পুরুষ আবার নারীবাদ নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা করে। তাঁদের কাছে নারীমুক্তির অর্থই হল মুক্তযৌনতা, খোলামেলা পোশাক পড়া ইত্যাদি। বর্তমান সময় অনেক পুরুষ নারীদের পণ্য ভাবে। তাঁরাও যে মানুষ এই কথাটা সেইসব পুরুষ ভুলে যায়।
সিমোন দ্য বোভোয়ার তাঁর মহাগ্রন্থ দ্বিতীয় লিঙ্গতে নারী সম্পর্কে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ
ও স্মরণীয়তম মন্তব্যটি করেন, “কেউ নারী হয়ে জন্ম নেয় না, বরং হয়ে উঠে নারী”। এই কথাটি
বেগম রোকেয়ার সময়ের নারীদের এবং আজকের নারীদের, উভয় ক্ষেত্রেই প্রাসঙ্গিক। বেগম রোকেয়ার
সময় নারীদের মুক্তি ছিল না, আজকের সময় নারীদের মুক্তি এসেছে, কিন্তু সেই সাথে আসেনি
মুক্ত পরিবেশ। আমরা নারীদের মুক্তি এনেছি ঠিকই, কিন্তু পুরুষদের শিক্ষিত করতে পারিনি।
যদি আমরা পুরুষদের শিক্ষিত করতে না পারি, যদি না নারীদের জন্য এক মুক্ত-নিরাপদ পরিবেশ
দিতে না পারি তবে বেগম রোকেয়ার সংগ্রাম এবং নারীবাদ একটি প্রহসনের নাম হবে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন