তমশার এই তীরে


 

জুতা জোড়া খুলে দরজার হাতলে হাত রাখা মাত্রই চারপাশ থেকে অন্ধকার এসে আমাকে রীতিমত গিলে খেয়ে নিল। সেই অন্ধকারের পেটে আমার শ্বাস নেয়াতে সামান্য কষ্টের মাঝে পড়তে হলো। অল্প করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমি ঘরের ভেতর প্রবেশ করলাম।

    'ভালোই তো হলো', বলে উঠলো রুমা। 'তোমাকে দেখে কারেন্ট যেমন করে দৌড় দিলো, আই উইশ আমিও এমন করে দৌড় দিয়ে চলে যেতে পারতাম।'

    কিছুই দেখতে পাচ্ছি না আমি। চোখ দুটি থেকেও নেই। আন্দাজের উপর ভরসা করে দরজাটা লাগালাম।

    'কি ব্যাপার ইউপিএস কাজ করছে না?' রুমার কথাগুলোকে প্রায় পুরোটুকু উপেক্ষা করে বললাম। 'জেনারেটরের কি হলো আবার?'

    'কি শুনতে পাচ্ছো না কিছু মিস্টার সিভিল সারভেন্ট কাম পার্টটাইম কবি কাম সুমনার সেক্স টয়...'

    'ইশ কিসব বলছো তুমি রুমা!'

    'হ্যাঁ এখন খুব ইশ ইশ মারাচ্ছো তাই না? কেন আজকে সুমনার সাথে ঠিক মতো জমে নাই?'

    'ওয়াট রাবিশ আর ইউ টকিং!' হাতের ব্রিফকেস ছুঁড়ে মারলাম সোফার এক পাশে, আন্দাজে। আন্দাজ ঠিক হলো না। ব্রিফকেসটি দুম করে শক্ত ফ্লোরে পড়ে মোটামুটি বিকট এক আওয়াজ সৃষ্টি করলো।

    'ও তাই? আমার কথা ভালো লাগতেছে না, না? সেটা এখন ভালো লাগবে কেন...'

    'শুনো', সামান্য ক্লান্ত স্বরে বললাম আমি। 'বুঝে শুনে কথা বলো, বাসায় কিন্তু সায়মন আছে।'

     'ওহ রাইট...', রুমার কথা শেষ হবার আগেই বাসার দেয়ালে লাগানো সব লাইট একসাথে জ্বলে উঠলো, মাথার উপরে থাকা সিলিং ফ্যান একে একে শূন্য থেকে চক্কর কাঁটা শুরু করলো, স্প্লিট এসিগুলো অন হয়ে পড়লো নীরবে। আকস্মাৎ এই কারেন্ট চলে আসার ফলে খানিকটা হকচকিয়ে গেছে রুমা। দেখলাম, কিছুটা দূরে ডাইনিং টেবিলের একপাশে সে দাঁড়িয়ে আছে। কি করছিল সে? আমার জন্য অপেক্ষা? কখন আমাকে এমন করে আক্রমণ করতে পারবে সেটার প্রতীক্ষা?

    গলা থেকে টাই লুজ করতে করতে আমি রুমাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলাম ভেতরের ঘরে। ঢোকার আগে শুনতে পেলাম সে গজগজ করতে করতে বলছে, 'আমি সব দেখে ছাড়বো। সবাইকে দেখে নিবো আমি।'

    ঘরের দরজা লাগিয়ে শরীর এলিয়ে দিলাম বিছানায়। খেয়াল করলাম, প্যালপিটিশন শুরু হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে, বুকের বাঁ পাশ কেউ হাতুড়ি দিয়ে পাঁজরের ভেতর ঘা মারছে জোরে জোরে। মনে হচ্ছে, একটু পর পাঁজরের হার ভেঙ্গে টকটকে হৃৎপিণ্ডটি বের হয়ে আসবে। চেয়ে চেয়ে দেখবো, বিছানার উপর রক্তাক্ত হৃৎপিণ্ডটি ধকধক করে বেজে চলছে অনবরত।

    ডাক্তার আবেদের কাছে এই সমস্যা নিয়ে গেলে সেইদিন অনেকটা সময় তিনি আমার রিপোর্টগুলো উল্টে-পাল্টে দেখেন। এক সময়, রিপোর্টগুলো থেকে চোখ না তুলে বলেন, 'আবেদিন সাহেব, আপনার আসলে আমার প্রেসক্রিপশনে কোনোই কাজ হবে না।'

    'তাহলে?' সামান্য উদ্বেগ নিয়ে জিজ্ঞেস করি।

    'আপনার আসলে', ডাক্তার আবেদ রিপোর্টগুলোর থেকে চোখ সরিয়ে আমার দিকে তাকান। সরাসরি। তারপর চশমাটা খুলে টেবিলে রেখে চেয়ারে হেলান দিয়ে বলেন, 'আপনার আসলে একজন সাইকোলজিস্ট দেখানো দরকার বুঝলেন। আমার মনে হচ্ছে কয়েক সেশন কনটিনিউ করলেই আপনি অনেকটা বেটার ফিল করবেন।'

    টেবিলের এক ড্রয়ার থেকে কিছুক্ষণ হাতড়ে একটি কার্ড বের করেন তিনি। 'ইনি আমার পরিচিত একজন সাইকোলজিস্ট। বেশ ভালো কিন্তু। আপনি উনার সাথে সময় করে যোগাযোগ করুণ।'

    ডাক্তার আবেদের চেম্বার থেকে গাড়ি করে আসার সময় গুলশান-১ এর মোড়ে জ্যামে বসে থাকতে থাকতে আমি নিজেকে নিয়ে ভাবি। অনেকটা সময়। অসুখটা তাহলে মনের? নিজেকে জিজ্ঞেস করি। কেমন অসুখ? ছোটবেলায় রচনা লেখার সময় একটা কোটেশন মুখস্ত করেছিলাম বলে মনে পড়ে। মেনজ সানা ইন কর্পরে সানো, যার অর্থ হলো সুস্থ দেহে সুস্থ মন। আমার ক্ষেত্রে তাহলে এর উল্টোটা হয়েছে, একশো আশি ডিগ্রি নয়, একেবারে তিনশত ষাট। অসুস্থ মনে অসুস্থ দেহ, বিড়বিড় করে বলি, নিজেকে।

    পরদিন অফিসের এক ফাঁকে আমি ডাক্তার আবেদের রেফার করা সাইকোলজিস্টের ক্লিনিকে কল করি। এক মিষ্টি গলার মেয়ে ফোনের অপর প্রান্ত থেকে বলে, 'গুড আফটার নুন, স্যানাশিও ক্লিনিক।'

    'হ্যালো। আমি কালকে একটা এপয়েন্টমেন্ট নিতে চাই...'

    আমার কথা ঠিক মতো শেষ করতে না দিয়েই সে প্রশ্ন করে, 'কার সাথে বসতে চাচ্ছেন স্যার?'

    'গিভ মি এ সেকেন্ড।' মানিব্যাগ থেকে ডাক্তার আবেদের দেয়া কার্ডটা বের করে নামটা দেখে নেই। 'মিস্টার ইসমাইল হাকিমি' বলি আমি।

    মেয়েটি খানিকটা সময় নিয়ে সবকিছু রেডি করে ফেলে। বৃহস্পতিবার বিকাল পাঁচটায় এপয়েন্টমেন্ট।

    'তাহলে স্যার আমি আবারও কনফার্ম করছি। কালকে বিকাল পাঁচটায় ইসমাইল হাকিমি স্যারের সাথে আপনার এপয়েন্টমেন্ট।' একটু থেমে বলে, 'কোন প্যাকেজটি আপনি নিবেন স্যার? প্রিমিয়াম...'

    এবার আমি তার কথা ঠিক মতো শেষ করতে না দিয়ে উত্তর দেই, 'প্রিমিয়াম।'

    'জ্বী, স্যার।' মনে হলো মেয়েটি অবাক হয়েছে।

    'স্যার আপনার নাম?'

    'আবেদিন আনসারী।'

    বিকেল পাঁচটায়, পরদিন, স্যানাশিও ক্লিনিকে প্রবেশ করি আমি। ইয়াং একটি মেয়ে, সম্ভবত সেই ফোনের মেয়েটাই, হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানিয়ে আমাকে একটি রুমে নিয়ে যায়। ভেতরে ঢুকে ধাক্কার মতো খাই, কারণ রুমটা প্রয়োজনের চাইতেও বেশি পরিপাটি করে রাখা, অসম্ভব গুছানো। একেকটি ধূলিকণা পর্যন্ত যেন জায়গা মতো, একদম নিজের নির্দিষ্ট জায়গায় বসে রয়েছে। দেখলাম, রুমের মাঝামাঝি এক জায়গায় দুটি রেকলাইনার মুখোমুখি রাখা, মাঝে একটি ছোট্ট গোল টেবিল; তাতে পরিপাটি করে রাখা পানিভর্তি কাঁচের জগ, দুটি খালি গ্লাস ও টিস্যু পেপারের বক্স। সামনের রেকলাইনারে বসে রয়েছেন যিনি, তিনিই সম্ভবত সাইকোলজিস্ট ইসমাইল হাকিমি। আমাকে দেখে হাসিমুখে অপরটায় বসতে বলেন। আমি বসি।

    'কেমন আছেন মিস্টার আনসারী?' জিজ্ঞেস করেন তিনি।

    'এইতো।'

    'আমাকে ডাক্তার আবেদ আপনার ব্যাপারে বলেছে আরকি। আমি আপনার মুখ থেকে এখন শুনতে চাই সবকিছু।' একটু থামেন তিনি। 'আমাদের কাছে সবকিছু কনফিডেনশিয়াল থাকে। আপনি একদম নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। তাছাড়া...'

    'জ্বী আমি জানি এগুলো।' আমি বলি। 'আপনাদের ওয়েবসাইটে পড়েছি।'

    'ওহ। গ্রেট। তাহলে শুরু করা যাক।' ইসমাইল হাকিমি বলেন।

    এবার একটু ভালো করে সাইকোলজিস্টের দিকে তাকাই। কেমন ইঁদুরের মতো চেহারা এই লোকের, মনে মনে বলি। ছোটবেলায় গ্রামে এক লোক ছিল, একদম এমন দেখতে। ইঁদুরের মতো গুটিগুটি চোখ। সুচালো মুখ। নাম ছিল সেলিম মিয়া।

    'একেবারে শুরু থেকেই শুরু করতে পারেন আপনি চাইলে। ছোটবেলা থেকেই।' নীরবতা ভেঙ্গে বলেন ইসমাইল হাকিমি।

    'জ্বী আসলে শুরুতে বলতে তেমন কিছু নেই।

    'আচ্ছা।' বলে তিনি কোলের উপর রাখা নোটবুকে কিছু একটা টুকে রাখেন। 'তাহলে এখনকার জীবন নিয়ে বলুন।'

    'আমি একজন সিভিল সারভেন্ট।' বলা শুরু করি। 'বর্তমানে গণযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে আছি এডিশনাল সেক্রেটারি হিসেবে। এমনি জব লাইফ ঠিক মতো আছে, আরও দশটা অফিসারের যেমন থাকে আরকি। নাথিং ডিফারেন্ট। আর জব বাদে আমি লেখালেখি করি। ইতোমধ্যে প্রায় চারটা কবিতার বই ও দুটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।' একটু থামি আমি।

    'ভেরি নাইস। এবার বইমেলায় আপনার বইগুলো সংগ্রহ করতে হবে দেখি। সরি, আমি তেমন সিরিয়াস সাহিত্যের পাঠক নই, তাই আজকাল কে কি লিখেছে তার খোঁজ-খবর রাখা হয় না।'

    'ইটস ওকে। আমি এমনিও এমন বড় কেউ না। যাইহোক। আমার বাসায় বর্তমানে আমার স্ত্রী ও আমি থাকি। আমাদের এক মেয়ে। এই বছর কানাডাতে পড়তে গিয়েছে। বাসায় তাই এখন বলতে গেলে আমরা দুইজন। মাঝে মাঝে আমার শ্যালক এসে থাকে।'

    মাথা নাড়ে ইসমাইল হাকিমি। আমি বলতে থাকি।

    'এমনি সব ঠিকঠাক। কোনো সমস্যা নেই। জাস্ট এই চার মাস আগে আমার অফিসে এক মেয়ে, মানে আমারই জুনিয়র এক অফিসারের সাথে ঘনিষ্ঠতা হয়। সুমনা তার নাম। বলে, আমার কবিতা নাকি ভীষণ পছন্দ। আমাকে নাকি অনলাইনে ফলো করে অনেক আগে থেকে, এইসব। এরপর থেকে ধীরে ধীরে আমাদের মেলামেশা বাড়ে। অফিসের বাইরেও প্রায় আমরা দেখা করি। কখনো কফিশপে, কখনো বইয়ের দোকানে। এভাবে মাস কয়েক পার হয়। একদিন ড্রাইভারের কি এক কাজ থাকে, তাকে ছুটি দিয়ে দেই। নিজেই ড্রাইভ করে যাবো বলে সিদ্ধান্ত নেই। তখন সুমনা এসে বলে তাকে তার বাসায় ড্রপ করে দিতে। আমি আর সে গাড়িতে উঠার পর তার বাসার দিকে না গিয়ে এক লং ড্রাইভে চলে যাই। সন্ধ্যা নামে, রাত হয়। হঠাৎ আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে ঝড় নামে। আমি রাস্তার এক ধারে গাড়ি থামাই। এন্ড তারপর কি থেকে কি হয়ে যায়, আমার স্পষ্ট মনে নেই। এক সময় বুঝতে পারি, উই ডিড এভরিথিং। বাট শুধু ওই রাতই। সুমনা বিবাহিত, আমিও। আমরা নিজেরা সিদ্ধান্ত নেই ব্যাপারটা থেকে পুরোপুরি সরে আসার। আমরা সচেতনভাবে নিজেদের দূরত্ব বাড়িয়ে নেই। কিন্তু বলে না দেয়ালেরও কান থাকে। আমার মনে হয় দেয়ালের চোখও থাকে, নাকও থাকে। কীভাবে কীভাবে জানি আমার ওয়াইফ পর্যন্ত ব্যাপারটা চলে যায়।'

    আমি একটু দম ফেলার জন্য সময় নেই। ইসমাইল হাকিমি বলেন, 'পানি খাবেন একটু মিস্টার আনসারী?'

    'নো থ্যাঙ্কস, আই অ্যাম অলরাইট।'

    আমি ভালো করে আবারও ইসমাইল হাকিমির দিকে তাকাই। আরও ভালো করে। দেখি, তার ইঁদুরের মতো চোখ দুটি আরও ছোট হয়ে আসছে। এই লোক কি সেলিম মিয়ার ছেলে কোনো কারণে? সেলিম মিয়ার কি কোনো ছেলে ছিল? মনে পড়ে না আমার। শুধু মনে পড়ে যায় এক ভরদুপুরের কথা, যেদিন সেলিম মিয়া আমাকে ফুসলিয়ে-ফাঁসলিয়ে গ্রামের অদূরে একটি জংলার মতো জায়গায় নিয়ে যায়। ওই জায়গায় বিষাক্ত সাপের উপদ্রব ছিল বলে কেউ ওইদিকের পথ মাড়াতো না। সেইদিনও কেউ যায়। এরপরের দিনও না। এরপরের দিনেও না। আর এই সুযোগের পুরো ব্যাবহার করে সেলিম মিয়া, দিনের পর দিন।

    'তারপর আপনার স্ত্রীর কথা বলুন। উনি জানার পর কি হলো?' চুপ করে থাকার কারণে আমাকে জিজ্ঞেস করেন ইসমাইল হাকিমি।

    'ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড...' আমি নরম রেকলাইনার থেকে উঠে দাড়াই।

    'আর ইউ ওকে মিস্টার আনসারী?'

    'টয়লেটটা কোথায় আপনাদের' এই বলতে বলতে সামনে রাখা গোল টেবিলের উপর ঝুঁকে বমি করে ফেলি আমি। আমার শরীরের ভেতর থেকে সব কিছু বের হয়ে আসতে চায় সেই বমির সাথে। আমি হরহর করে বমি করতে থাকি। মনে হয়, এই বমি বুঝি কখনো বন্ধ হবে না।

    একটু ধাতস্ত হলে আমাকে ওই রুম থেকে অন্য আরেকটি রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। পুরোটা সময় ইসমাইল হাকিমি পাশে থাকেন। একটু পরপর বলেন, 'আর ইউ সিউর আপনি ঠিক আছেন মিস্টার আনসারী?' প্রতিবার এর উত্তরে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ি আমি।

       স্যানাশিও ক্লিনিক থেকে চলে যাওয়ার আগে ওই মেয়েটি, যে আমাকে ভেতরে নিয়ে এসেছিল, খুব সম্ভবত সেই মিষ্টি গলার মেয়েটিই হবে, একটি রিসিট নিয়ে আসে। দেখি, ফি এর জায়গায় ৮,৫০০/- লেখা। আমি তাকাই মেয়েটির দিকে। 

    'এইটা স্যার আপনার বিল, প্রিমিয়াম প্যাকেজ।'

    মানিব্যাগ থেকে কার্ড বের করে দেই। 

    'সরি স্যার, আমরা শুধু ক্যাশে পেমেন্ট নেই।' বলে মেয়েটা মিষ্টি গলায়।

    পকেটে হাত ঢুকিয়ে দেখি, এক কোণায় শাহেদা বুয়ার বেতনের আট হাজার টাকা রাখা। আমি সেটা বের করে মানিব্যাগ থেকে আরও পাঁচশত টাকার নোট যোগ করে পুরোটা সেই মেয়ের হাতে দিয়ে বের হয়ে পড়ি।


'এই খুলো।' দরজার ওপাশ থেকে রুমা চেঁচিয়ে বলল। আমি উঠে বসলাম বিছানায়।

    'দরজা লক করি নাই তো,' বললাম আমি।

    'দরজাটা খুলো।'

    উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেখি সুটকেস হাতে রুমা দাঁড়িয়ে আছে। চোখ দুটি লাল লাল।

    'বহুত সহ্য করা শেষ আমার। আর না।' বলল রুমা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে। 'তুই ওই মাগিকে নিয়ে পড়ে থাক। তোর বাসা ফাঁকা করে দিয়ে গেলাম, এখন ওরে নিয়ে এসে বিছানায় শোয়া।'

    বলে গটগট করে সে যেতে থাকে মেইন দরজার দিকে। পেছন থেকে আমি বললাম, 'দিন দিন কি পাগলামি করছো তুমি রুমা? উই ক্যান টক...'

    'ও তাই?' পিছে ঘুরে বলল সে। 'আমার সাথে তুই কথা বলবি? কি কথা? কোথায় কোথায় আমি তোর মতো অ্যাকাউন্ট খুলে রেখে আসছি সেইগুলা নিয়ে কথা বলবি তুই হারামির বাচ্চা!'

    চিৎকার করে উঠে রুমা। তার গলার স্বর ফাঁপা বাশের মতো ভেঙ্গে আসে।

    'শুনো রুমা, এই দিকে আসো...' কথা শেষ করার আগে হাতের কাছে রাখা ক্রিস্টালের ফুলদানি হঠাৎ সে ছুঁড়ে মারে আমার দিকে। কোনোমতে সরে গিয়ে নিজেকে বাঁচাই আমি।

    'তোরে আমি কোর্টে গিয়ে দেখে নিচ্ছি দাড়া। একেবারে তোকে নেংটা করে ছেঁড়ে দিবো হারামির বাচ্চা!'

    সশব্দে মেইন গেট লাগিয়ে চলে যায় রুমা। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখি। ঝুপ করে সবকিছু কেমন থেমে গেল, ভরদুপুরের গোরস্থানের মতো।

 

বারান্দার ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছি। আজ ভরা পূর্ণিমার রাত। বাইরে অনেক দিন পর সুন্দর হাওয়া বইছে। কিছু দূরে শিরিষ গাছের পাতাগুলো সেই হাওয়ায় দোল খাচ্ছে। নিচের ফ্লোরে থাকেন রঞ্জিত দা। তার স্ত্রী ফাল্গুনী আপা এক গাঁদা নাইট কুইন লাগিয়েছে নিজের বারান্দায়। সেই সৌরভ আমি এই উপরে ইজিচেয়ারে বসেও পাচ্ছি, মৌ মৌ করছে চারপাশ।

    সেই গন্ধে, বাইরের হাওয়ায় আমার শরীরে এক অচেনা ক্লান্তি এসে জমাট বাঁধে। আমি ভাবি, রুমার তো অনেক আগেই চলে যাওয়ার কথা। কেন গেল না সে? এই আজকের তারিখ কেন সে বেছে নিল চলে যাওয়ার জন্য?

    এক অপরিচিত কণ্ঠ আমার চিন্তায় বাঁধার দেয়াল হয়ে দাঁড়ায়, 'হ্যালো।'

    ঘাড় ঘুরিয়ে পিছে তাকাই। লাইট অফ করা অন্ধকার রুম ছাড়া কিছুই চোখে পড়ে না। 'হ্যালো, ভালো আছেন?' আমি আবারও শুনি। কেমন খসখসে এক কণ্ঠে।

    আবারও ভালো করে তাকাই। কেউকে দেখতে পাই না। প্রথমে ভেবেছিলাম সায়মন বুঝি, কিন্তু বাসায় আমি ছাড়া আর কেউ নেই এখন। হঠাৎ করে নাকে এক পোড়া, ঝলসানো গন্ধ পাই। মাংস পোড়ালে যেমন গন্ধ বের হয়, তেমন। ধীরে ধীরে আমার প্যালপিটিশন শুরু হয়ে যায়।

    ইজিচেয়ার থেকে উঠে বারান্দার লাইটের সুইচে চাপ দেই। লাইট জ্বলে না। বার বার অন-অফ করে দেখি। একবারও জ্বলে না। বাইরে তাকিয়ে বুঝি কারেন্ট আবার গিয়েছে। জেনারেটরের কি হলো আজ?

    'ঘাবড়াবেন না। আজকে আমাকে সুযোগ করে দিলো বলে চলে আসলাম।'

    কি মনে করে আমি পায়ের দিকে তাকাই। তাকিয়ে, এই আলো-ছায়ায় দেখতে পাই একটা বিড়াল আমার পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে কোনো পশম নেই। চামড়া পুড়ে ঝলসে গেছে। জায়গায় জায়গায় আবছাভাবে বিভিন্ন ক্ষতচিহ্ন দেখা যাচ্ছে।

    'আমার হাতে সময় নেই। কয়েকটা কথা বলেই চলে যাবো আমি।'

    ধীরে ধীরে ইজিচেয়ারে বসে পড়ি। খেয়াল করি, আমার বুকের ভেতর হাতুড়ি দিয়ে বাড়ি দিয়ে চলছে কেউ অনবরত।

    'আগে বলেন কেমন আছেন?'

    'হু।'

    'ভালো। আমি আসলে এসেছি আপনাকে ধন্যবাদ দিতে। এমন সুযোগ আসেই না। আজকে পেলাম তাই চলে এলাম এভাবে।'

    আমি ভালো করে বিড়ালটার দিকে তাকাই। বিড়ালটাও আমার দিকে তাকায়। দেখি, মুখ তার ঝলসে বিকৃত বীভৎস হয়ে গেছে। 

    'আপনার মনে পড়ে সেইদিনের কথা, যেদিন আপনি আপনার বন্ধুদের সাথে করে আমার পুরো শরীরে কেরসিন মেখে আগুনে ছুঁড়ে ফেলেছিলেন? আমি যতবারই বের হয়ে আসতে চাইছিলাম ততবার আমাকে আবার সেই আগুনের কুণ্ডলীতে ছুঁড়ে ফেলছিলেন। মনে পড়ে?'

    '...'

    'প্রথম প্রথম ভয়ানক কষ্ট পেয়েছিলাম। বীভৎসরকমের। পরে ভেবে দেখলাম,' বিড়াল একটু থেমে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে, 'সেইদিন যা করেছিলেন ঠিকই করেছিলেন। আমার বয়স কম ছিল তখন। পুরো জীবন ছিল আমার সামনে। আমি এখন জেনেছি, বুঝেছি, এই পৃথিবীতে থাকতে হলে কষ্ট পাওয়া ছাড়া গতি নাই। ওই যে বলে না নির্বাণ, মুক্তি ইত্যাদি; সেগুলো কিন্তু সবার জন্য না। সবাইকে, হ্যাঁ, প্রায় সবাইকে আজীবন সহ্য করে যেতে হয়; নির্বাণের পথ মেজরিটির জন্য চিরতরে বন্ধ থাকে। কারো কারো তো সেই পথ বলেই কিছু থাকে না। আমি জানি, সেইদিন না মেরে ফেললে আজীবন আমাকে হাজারো দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে যেতে হতো। কোনো ভাবেই আমি নিজেকে সেইসব থেকে মুক্ত করতে পারতাম না। আমাদের আসলে নির্বাণ বলে কিছু নেই। আমি আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞ, আমাকে এতো এতো কষ্টের থেকে বাঁচিয়ে দিলেন কত দ্রুত। আপনাদের একজনের ভাষায়, "আমারে তুমি অশেষ করেছো, এমনি লীলা তব!" কিন্ত,' বিড়ালটি এবার চুপচাপ হয়ে পড়ে কেন জানি। আমাদের মধ্যে কত সময় নীরবে গড়িয়ে পড়ে জানি না।

    'আমাকে এইভাবে পুড়িয়ে না মারলেও পারতেন। আরও কম কষ্টে কি আমাকে মেরে ফেলা যেত না?'

    'হয়তো।' বলি আমি। নিচুস্বরে।

    'যাইহোক, ব্যাপার না।' বিড়ালটি খসখসে গলায় বলে, 'আমার সময় ফুরিয়ে গেছে। যাই এখন। ভালো থাকবেন আপনি।'

    রুমা চলে যাবার পর ঝুপ করে যেভাবে নীরবতা নেমে এসেছিল আমার চারপাশে, বিড়ালটি চলে যাবার পরও একই রকম নীরবতা, কিংবা তার চেয়েও খানিকটা বেশিই, নেমে এসে বসলো আমার আশেপাশে। আষ্টে-পৃষ্টে আমাকে বেঁধে রাখলো সেই নীরবতা, নিস্তব্ধতা। উঠে দাঁড়িয়ে বারান্দার রেলিঙের কাছে চলে যাই আমি। অল্প কিছু হাওয়া আমার চুল আলতো করে ছুঁয়ে চলে যায়। নিচে তাকাই, দেখি দু-তিনটা কুকুর রাস্তার উপর ধীর পায়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে এই আঁধারে। এই দূর থেকে কত ক্ষুদ্র লাগছে তাদের। কুকুর নয়, ছোট ছোট পোকা যেন তারা।

    আমি এক দৃষ্টিতে নিচে তাকিয়ে রইলাম। তাকিয়েই রইলাম।

~ সমাপ্ত ~

[এই ব্লগসাইটে এখন থেকে আমার লেখা অপ্রকাশিত গল্পগুলো প্রকাশিত হতে থাকবে একের পর এক। কবে কখন প্রকাশিত হবে সেটা আমিও জানি না, কিন্তু হবে এইটা নিশ্চিত। ভালো লাগলে, এমনকি খারাপ লাগলেও কমেন্ট করে জানাবেন। হ্যাপি রিডিং! ]

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ