ইতি, নাজিব
এইখানে তিনটা চিঠি রয়েছে। চিঠিগুলোর লেখক, প্রেরক আমি। চিঠি দিয়ে মনের ভেতরকার অনেক কথা এমনভাবে বলা যায় যা টেক্সটিং, অডিও কল কিংবা ভিডিও কলে সম্ভব হয় না। চিঠিগুলো পড়লে হয়তো একটু হলেও ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন।
অনেকের কাছে চিঠিগুলো পড়ার সময় একটু এলোমেলো লাগতে পারে। কিন্তু আমি মনে করি, ওই এলোমেলো ব্যাপারটাই চিঠিগুলোর সৌন্দর্য।
এই চিঠির প্রাপক কে তা একেবারেই গৌণ এক আলোচনা। চিঠির ভেতরের কথা সত্য কি মিথ্যা এই আলোচনাও একেবারে গৌণ। যদিও গৌণ জিনিস নিয়ে লাফালাফি করা আমাদের স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছে!
যাইহোক, চিঠি পাঠ শুভ হোক আপনাদের!
১০ জানুয়ারি, ২০২৩।
হ্যালো,
কেমন আছো তুমি?
বেশ কিছু সপ্তাহ ধরেই দিনকাল ভালো যাচ্ছে না। বিশেষ করে বেশ কয়েক রাত খুব খারাপ গিয়েছে। গত রাতে তো এক ফোঁটা ঘুম আসেনি। পুরো রাত আমি জেগে কাটিয়েছি। জানি না আমার কি হয়। প্রচুর রাগ হয় সব কিছুর উপর। প্রচণ্ড অভিমানে ভেতরের সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। কিন্তু এই রাগ, এই অভিমানের উৎস কোথায়, ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। তোমার উপর এক সময়ে রাগ হয়, এক সময় নিজের উপর। প্রায় সময়েই নিজের নষ্ট ভাগ্যকে গালি দেই আমি। চাচ্ছিলাম না তোমাকে কিছু বলতে। বলে কি হবে? না তুমি কিছু করতে পারবে, না অন্য কেউ। এই রক্তক্ষয় আর কতদিন চলবে আমার ভেতরে, জানি না।
আমি মাকেও বলতাম না কিছু। পড়ে গত রাতে যখন একদমই ঘুমাতে পারিনি তখন তাকে বলি, কিসব হচ্ছে আমার সাথে। মা আমাকে বুঝায়। অল্প হলেও কাজে দেয়। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? আমি জানি না। ভালো থাকি, কিন্তু সেই ভালো থাকা বেশিদিন স্থায়ী হয় না। মাঝে মাঝে লাগে সবকিছু ছেঁড়ে দিয়ে অনেক দূরে কোথাও চলে যাই। সবাইকে, একদম সবাইকে ছেঁড়ে। মাঝে মাঝে লাগে, হঠাৎ কোনো দুর্ঘটনায় যদি মারা যাই?
সত্যি বলতে, মৃত্যুকে তেমন একটা ভয় পাই না। খুব সম্ভবত দাদার মৃত্যুর পর থেকে এমনটা হয়েছে। দাদার কবরে, দাদাকে শোয়ানোর আগে, আমি সেখানে নামি। শূন্য কবরে খানিকক্ষণ সময় কাটাই। হয়তো এক মিনিট, হয়তো দুই মিনিট, কিংবা কে জানে পাঁচ মিনিটই হয়তো। অথচ আমার লাগে, পুরো জগত থেকে বিচ্ছিন্ন ওই কবরের ভেতর আমি সৃষ্টির শুরু থেকে বিরাজ করছি। তখনই হয়তো, ওই সময়টায়, আমি চিরতরে পাল্টে যাই।
এখনো বুঝতে পারছি না, ওই পাল্টে যাওয়ার ফলাফল আসলে কি।
জানো, নিজেকে কেমন যেন গুঁটিয়ে ফেলছি নিজের মধ্যে। কি বলি, না বলি, অনেক সময় নিজেই বুঝি না। এর উপর বাসা থেকে দূরে থাকা, পড়াশোনার চাপ, সব মিলিয়ে এতো দুরাবস্থায় আছি যে বলে বুঝাতে পারবো না।
আমার সাথেই কেন এমন হতে গেল? মাঝে মাঝে লাগে, কি এমন করলাম যার জন্য এইসব ফেস করতে হচ্ছে? বুঝি না। কিছুই বুঝি না। বুঝতে পারি না।
প্রায় সময়েই নানান রকম কষ্ট দিয়েছি তোমাকে। মাফ করে দিও।
আমি চেষ্টা করবো তোমার পাশে থাকার। তোমাকে তো কথা দিয়েছি পাশে থাকার, চেষ্টা করবো সেই কথা রাখার। আশা করি, এক সময় আমি তোমাকে ভালোবাসা বন্ধ করতে পারবো। যদি আমাদের মধ্যে একটি সুইচ থাকতো যা দিয়ে ভালোবাসা বন্ধ করা যেত তবে কত ভালোই না হতো। তাই না?
ভালো থেকো।
বাই।
নাজিব।
~
এরপরের চিঠি লেখা ফেব্রুয়ারির ছয় তারিখে।
~
০৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩।
হ্যালো,
আশা করি তুমি ভালো আছো। যদিও জানি, খারাপ-ভালো মিলিয়েই মানুষের জীবন। তোমার জীবনও এর চেয়ে ভিন্ন কিছু নয়। হয়তো তোমার জানতে ইচ্ছে করছে, কেমন আছি আমি, কেমন করছি। এটা জানানোর জন্যই লিখতে বসলাম।
প্রথমত জীবনে ব্যস্ততা প্রচুর রকমের বেড়েছে। সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা চলছে, তাই সঙ্গত কারণে ব্যস্ততা একটু বেশিই। দিন যতই যাচ্ছে, এই ব্যস্ততাকে ততই অসহ্য মনে হচ্ছে। এর মূল কারণ যতটুকু মনে হয় তা হলো ইঞ্জিনিয়ারিং এর প্রতি আমার বিতৃষ্ণা। এটি বললে মিথ্যা বলা হবে যে, ইঞ্জিনিয়ারিং আমার দুই চোখের বিষ, পড়া বুঝছি না, একদম নিতে পারছি না, পরীক্ষা খারাপ হচ্ছে; ব্যাপারটা তেমন নয়। ব্যাপারটা হলো, আমার লাগে এই ফিল্ডে কাজ না করে অন্য কোনো ফিল্ডে, যেমন সাহিত্য, ফিল্মমেকিং, পেইনটিং, গান, এইসবে কাজ করলে বড্ড বেশি ভালো লাগতো। পরিপূর্ণতা অনুভব করতাম। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে ভেতরে, নিজের মধ্যে, একদমই পরিপূর্ণতা অনুভব করি না। এও আমি জানি, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে বেশিদূর যেতে পারবো না। তবুও পড়তে হচ্ছে এইসব; রাতের পর রাত জেগে। ভেতরে শূন্যতা ছাড়া কিছু মনে হয় নেই এখন আমার। যাইহোক, এইসবের মধ্যেই চেষ্টা করি মনের কাজগুলো করার। এইবার বইমেলায় থেকে কয়েকটা বই পছন্দ করে কিনেছি। ইচ্ছা আছে দ্রুত পড়ে ফেলার। বাসায় আরও কিছু বই লিস্টে আছে পড়ার জন্য। পরীক্ষা শেষ হলে আবারও বইমেলায় ঢু দেবার ইচ্ছা আছে। দেখি কি হয়। তা ছাড়া পরের সেমিস্টারের মিডের মধ্যেই আমার শর্ট ফিল্মের শুটিং শেষ করে ফেলতে চাচ্ছি। ফিল্মের স্ক্রিপ্টের ড্রাফট এইবার মনের মতো হয়েছে বলে লাগছে। দেখি, কতদূর ব্যাপারটা গড়ায়।
তোমার কথা প্রায়ই মনে পড়ে আমার। সব সময় না হলেও প্রায় সময়ই তোমার শূন্যতার গন্ধ আমি পাই। বেশ তীব্র সেই গন্ধ। আমাকে মোহাচ্ছন্ন করে রাখে। তোমার সাথে কি অদ্ভুত সুন্দর একটা সময়ই না আমি কাটিয়েছি। কি অদ্ভুত মায়াবী ছিল সেইসব দিনরাত্রি! এখন কোনো অলস বিকেলে বসে বসে এইসব মনে পড়লে লাগে সবকিছু যেন কয়েকদিন আগে দেখা মিষ্টি এক স্বপ্ন। আর এক স্বপ্ন মানুষ কখনোই দুইবার দেখে না।
মনে আছে তোমার, সম্পর্কের সেই শুরুর দিনগুলোতে দুই সপ্তাহ পর পর বাসে করে রাজশাহী থেকে ঢাকা চলে আসতাম তোমার সাথে দেখা করতে? ট্রেনে করে প্রায় কখনোই আসতাম না। কারণ, বাসে করে এলে বাস এসে থামতো তোমার ইউনির সামনে। ট্রেনে করে এলে তা সম্ভব হতো না, এমনকি এতো ঘন ঘন আসার সুযোগও হতো না। আমি পথে কয়েক কেজি ধুলো খেয়ে, বাস থেকে নেমে বোতলের পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে তোমার সাথে দেখা করতে যেতাম। মনে পড়ে একবার, প্রচুর জ্যামের কারণে বাস আমার আটকে থাকে হোটেল রেডিসনের সামনে। বাসে বসে রয়েছি সেই প্রায় আট ঘণ্টার মতো। ইতোমধ্যে তোমার ক্লাস শেষ অনেক আগে। তুমি দাঁড়িয়ে ছিলে আমার জন্য। ওই রেডিসনের সামনেই আমি ব্যাগ নিয়ে নেমে যাই। এবং হাঁটা শুরু করে দেই। হাঁটতে হাঁটতে চলে আসি বনানী গোরস্থানের সামনে। ওইখান থেকে উবারের মোটর বাইকে করে ছুটে চলি তোমার কাছে। ততক্ষণে ঢাকার আকাশে সন্ধ্যা নেমেও বেশ কিছু সময় পার হয়ে গিয়েছে। বাইক আমাকে রাস্তার এই পাশে নামিয়ে দেয়। ওপাড়ে দাঁড়িয়ে ছিলে তুমি।
মনে পড়ে তোমার এইসব দিনগুলোর কথা?
আজকাল আমি ট্রেনে যাওয়া আসা করি। ট্রেন স্টেশনের পাসেই রয়েছে বাস কাউন্টার। ঢাকায় যাবার সময়ে যখন স্টেশনে ঢুকি তখন আলতো করে সেই বাস কাউন্টারের দিকে তাকিয়ে থাকি। ভেতরে কেমন লাগে তা ঠিক সংজ্ঞায়িত করতে পারবো না আমি। অনেকটা বিমূর্ত চিত্রকর্মের মতো। যদিও এবার ঢাকায় আসি বাসে চেপে। বহু বহু দিন পর বাসে ফিরি ঢাকাতে। এই প্রথমবার মনে হয় বাসে করে ঢাকায় ফেরার সময় তোমায় সামনাসামনি দেখার স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকিনি। কেমন রুক্ষ ছিল পুরো যাত্রা।
এইবার বইমেলা থেকে ফেরার সময়ে জানো কিসের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম? যেখানে আমি প্রথম তোমার হাত ধরি সেই জায়গা। কত না স্মৃতির সাথে জড়িয়ে রয়েছে এই রমনা পার্ক, পার্কের সামনের রাস্তা, যা শেষ হয় অফিসার্স ক্লাবে গিয়ে। মনে হয় না ২০২০ সালের পর আজ অবধি তোমাকে ছাড়া এই রমনা পার্কে প্রবেশ করেছি। মনে হয় না কখনো আমার আর সেইখানে যাওয়া হবে। দূর থেকে দেখলাম, পার্কটা আগের মতো তেমন নেই। ভেতরে কিছু নতুন জিনিসের সংযোজন হয়েছে। সময়ের সাথে সাথে এক সময় সবই পাল্টে যায়।
বেশ কিছুদিন হলো কেন জানি উপন্যাস লিখতে ইচ্ছে করছে। ইচ্ছাটা বেশ প্রবল। কিন্তু সময়ের স্বল্পতার কারণে কিছু করতে পারছি না। সামনের দিনগুলোতে পারবো বলেও মনে হচ্ছে না।
যাইহোক, আমি এখন যাই। অনেক কিছু বকে গেলাম। এবার যাই। হঠাৎ করেই তোমার কাছে লিখতে ইচ্ছে হলো বলে লিখলাম। বিশেষ কোনো কারণ নেই। আমি ঠিক আছি। আর ঠিক থাকলেই আমি খুশি। সামনের দিনগুলোতে যেইভাবে চাচ্ছি, সেইভাবে পার হলে সেই খুশি আরও বাড়বে।
আমি খুব করে চাই তুমি ভালো থাকো। পৃথিবীর সব সুখ, সকল সুন্দর কিছু তোমার হোক।
আর হ্যাঁ, নিজের যত্ন নিও। কোনোভাবে তোমার সাহায্যে আসতে পারলে জানাতে দেরি করবে না কিন্তু। আমি সারাজীবনের জন্য তোমার পাশে আছি, সাথে না থাকলেও।
ভালো থেকো তুমি।
ইতি,
নাজিব।
~
তারপর মার্চের ২৮ তারিখে আরেকটি চিঠি লেখা হয়।
~
২৮ মার্চ, ২০২৩।
আশা করি ভালো আছো।
কোথায় যেন পড়েছিলাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কোনো এক জায়গায় বলেছিলেন বা লিখেছিলেন, "পৃথিবীতে বালিকার প্রথম প্রেমের মতো সর্বগ্রাসী প্রেম আর কিছুই নেই। প্রথম যৌবনে বালিকা যাকে ভালোবাসে তাহার মতো সৌভাগ্যবানও আর কেহই নাই। যদিও সে প্রেম অধিকাংশ সময় অপ্রকাশিত থেকে যায়, কিন্তু সেই প্রেমের আগুন বালিকাকে সারাজীবন পোড়ায়।" এক সময়ে নিজেকে ভাগ্যবান মনে হলেও একটা সময়ে বুঝতে পারি আমি খুব একটা ভাগ্যবান নই। এতে এক সময়ে আফসোস রইলেও কিছুই বোধ হয় না আমার।
যাইহোক, যেইটা বলার জন্য লেখা সেটি হলো, আমি আমার সোশ্যাল মিডিয়ার সকল একাউন্ট বন্ধ করে দিয়েছি। তুমি নিশ্চিত হতে চাইলে যে কারো আইডি দিয়ে চেক করতে পারো। প্রায় সময় নানান রকমের কষ্টে থাকি। আর কষ্ট পেতে ভালো লাগছে না। কষ্ট, দুঃখ পেতে পেতে এক প্রকার বিরক্তই হয়ে পড়েছি। আর এইসব ভালো লাগে না।
আরেকটা কথা। তুমি কোনো ছেলের সাথে সম্পর্কে গেলে (তা যেরকম সম্পর্কই হোক) বা কাউকে বিয়ে করলে অবশ্যই করবে। কিন্তু চেষ্টা করবে কথাটা আমার কান পর্যন্ত যেন না আসে। আসলেও ক্ষতি নেই কোনো। তবুও চেষ্টাটুকু করে দেখবে। এই আমার একটা অনুরোধ রেখো।
আর হ্যাঁ। খুব বেশি বিপদে পড়লে, যে বিপদে হয়তো আমি ছাড়া কেউই তোমাকে সাহায্য করতে পারবে না, এমন কিছু বাদে আমার সাথে তেমন যোগাযোগের চেষ্টা করার দরকার নেই। আমি সবসময় তোমার পাশে আছি, কিন্তু সাথে নেই। হয়তো সাথে কখনোই থাকতে পারবো না। অতএব, আমার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করার দরকার নেই। এই মেইলের রিপ্লাইও দেবার দরকার নেই। কিন্তু হ্যাঁ, যেমনটা বলেছি, এমন কিছু যদি থাকে যেটায় আমি ছাড়া হবে না তাহলে ভিন্ন কথা। আশা করি তোমার জীবনে এমন কিছু আসবে না যার জন্য তোমার আমাকে প্রয়োজন। আমাকে ছাড়া তুমি ভালোই আছো, সামনেও থাকবে এই আশা আমি রাখি।
শেষ কথা। প্রায় অনেক দিন ধরেই লাগছে আমার আয়ু আর বেশি নেই। হয়তো কোনো মরণঘাতী রোগ আমাকে মেরে ফেলবে, নতুবা নিজেই নিজেকে হত্যা করবো। এমনটি আবার নাও হতে পারে। দেখা যাবে তোমার থেকেও বেশি আয়ু পেয়ে গিয়েছি আমি। আয়ু আমার বেশি হোক বা কম, আমার কিছু যায় আসে না। শূন্য থেকে জন্ম নিয়েছি, আবার শূন্যে ফেরত যাবো; আজকে, কালকে অথবা একশো বছর পর।
বাসার সবাই ভালো আছে। এদের দেখে এতো কিছুর মধ্যেও ভালো লাগে। বাসার এই মানুষগুলো না রইলে আমি নিজে বেঁচে থাকার কোনো কারণ খুঁজে পেতাম না।
ইতি,
নাজিব।
লেখা বেশ ভালো হয়েছে
উত্তরমুছুনসত্য সুন্দর
উত্তরমুছুন