যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাঁধা-ব্যবধান
বাবার সাথে মামলার একটি ড্রাফট রেডি করছি। বাবার হাতে মামলা রিলেটেড যাবতীয় কাগজপত্র। আমার আঙ্গুল কি-বোর্ডে। বাবা মামলার বিবরণী বলে যাচ্ছে। আমি টাইপ করে যাচ্ছি।
মোবারক মিয়া (২৫, ছদ্মনাম) প্রায় পাঁচদিন ধরে নিখোঁজ। লাপাত্তা। কোনো খোঁজখবর না পেয়ে মোবারক মিয়ার পরিবার অবশেষে থানায় ইনফর্ম করে। পুলিশ তল্লাশি চালায় এবং কয়েকদিন পর এক জায়গায় মোবারক মিয়ার লাশ খুঁজে পায়। মোবারক মিয়াকে ছুরিকাঘাত করে মারা হয়েছে। সব দেখে পুলিশ তদন্ত চালায় এবং দ্রুতই খুনিকে খুঁজে বের করে। মোবারক মিয়াকে খুন করে তারই সাথে একই হোটেলে কাজ করা আল আমীন (১৯, ছদ্মনাম)। খুনের অভিযোগে আল আমীনকে জজ কোর্টে পেশ করা হয়। সে খুনি প্রমাণিত হয় ঠিকই কিন্তু বিচারকের রায় আল আমীনের পক্ষ মেনে নেয় না। আপিল করে হাইকোর্টে।
এই পর্যন্ত লিখে থেমে যাই। বাবা ফাইল পত্র ঘাঁটতে থাকে। মোবারক মিয়াকে ছুরি মেরে খুন করেছে আল আমীন। সবই বুঝলাম। আমি তেমন একটা আনকমফোর্টেবল ফিল করি না। মার্ডার তো আমাদের চারপাশে হয়েই থাকে, এতে আর আশ্চর্যের কী?
এক পর্যায়ে ফাইলপত্র ঘাঁটতে গিয়ে একটি তথ্য পায় বাবা, যা দিয়ে কেস অনেকটাই ঘুরিয়ে ফেলা যাবে। আমি লিখতে থাকি।
মোবারক মিয়া ও আল আমীন একই হোটেলে কাজ করতো। একই সাথে একই বাসায় থাকতো। তো কাহিনীটা হচ্ছে, এই ২৫ বছর বয়সী মোবারক মিয়া প্রায় অনেক দিন ধরেই ১৯ বছর বয়সী আল আমীনকে বলাৎকার করে যাচ্ছিল। নানান কারণে আল আমীনকে এইটা সহ্য করে যেতে হয়েছে। এমনই একদিন রেপ করতে যাবে, তখন আল আমীন বাধা দেয়। এতে মোবারক মিয়া ক্ষেপে গিয়ে ওকে চাকু দিয়ে ভয় দেখায়। তখন ওদের মাঝে ধস্তাধস্তি হয় এবং চাকু এসে লাগে মোবারক মিয়ার শরীরে। আল আমীন তখন কি করবে কিছুই বুঝতে পারছিল না। মোবারক মিয়া মারা যায়। সেই লাশ আল আমীন পরে কোনো এক জায়গায় লুকিয়ে রাখে, কিন্তু অবশেষে ধরা পড়ে যায়।
বিবরণীর এই পর্যায়ে এসে আমি আর স্থির থাকতে পারি না। শরীর রীতিমত গুলিয়ে আসি। মুখ বিকৃত করে বলি, 'কি রে ভাই, এইটা কোনো কথা নাকি। ছি ছি!'
মানে, এমন কাহিনী নাটক-সিনেমা কিংবা গল্প-উপন্যাসে থাকলে এইরকম লাগতো না। কিন্তু এইটা একবারে রিয়েল কাহিনী। প্রতিটা জিনিস সত্যি। আল আমীন নামের লোকটি আসলেই হাজতে বসে আছে এখন, মোবারক মিয়ার কবর দুপুরের রোদে ঝাঁ ঝাঁ করছে।
বাবা আমার অস্বস্তিকে দুই পয়সার দাম না দিয়ে তুড়ি মেরে বললো, 'এইযে ইম্পর্টেন্ট পয়েন্ট পেয়ে গেছি। চার নাম্বার গ্রাউন্ড লিখে ফেলো দেখি...'
বাবার কথা থামিয়ে বলি, 'ওয়েট। তোমার এই বিবরণী দেখে একটু গা গুলাচ্ছে না? এতো নরমালি এইসব জিনিস নিলা কেমনে? আমার গা রীতিমত রিরি করতেছে!'
সীমাহীন বিরক্তি নিয়ে বাবা বললো, 'তাড়াতাড়ি এই ড্রাফটটা শেষ করতে হবে। এরপর ইয়াবার মামলা আছে। তুমি লিখো যা বলি, দেরি কইরো না তো।'
আমি অবাক হয়ে গেলাম। বাবার এইসব নিয়ে একটুও মাথা ব্যাথা নাই। উল্টো যেন বলাৎকারের কাহিনীটা জানতে পেয়ে খুশি হয়েছে, কেননা বলাৎকারের পয়েন্টের জন্য আল আমীনের সাজা কমবে, জামিনও হয়ে যেতে পারে। আর বাবা এতেই খুশি। এই চরম নিকৃষ্ট ঘটনা বাবার মনে একটুও রেখাপাত করতে পারলো না। ব্যাপারটা তাই আমাকে বিস্মিত করে।
বাবা এই ব্যাপারটা বুঝতে পারলো একটু পর। নিজে থেকে বলে উঠলো, 'আইনের পেশায় থাকতে হইলে চামড়া একটু মোটা করতেই হয়। এইগুলো তো কিছু না, আরো কত কেইস দেখছি। এই আমার কাছেই একটা কেইস আসছিল যেইখানে বাবা তার আপন মেয়েকে দিনের পর দিন রেপ করেছে, ছেলে তার মাকে প্রোস্টিটিউশনে নামিয়ে দিয়েছে। সেইদিন ঢাকা ল রিপোর্টে একটা কেস দেখলাম, সম্পত্তির নিয়ে ঝামেলা হয়ে একটা ছেলেকে কেটে টুকরো টুকরো করে দেশের একেক জায়গায় শরীরের একেক অংশ ফেলে রাখা হয়েছে। ছেলের পরিবার এখনো ছেলের শরীর সব টুকরো পায় নাই হয়তো বা, না পেয়েই ছেলেকে দাফন করে দিয়েছে। কে জানে, যখন ছেলের কবরে মাটি দিয়ে হচ্ছিল তখন ছেলের শরীরের কোনো এক অংশ কুকুর কিংবা শিয়াল কামড়িয়ে খাচ্ছিল। এইগুলো ঘটনা শুনে আবেগী হয়ে তো আর কেইস জেতা যায় না। মক্কেলের দেয়া টাকা তো হালাল করতে হবে। তাই না?'
আমি মনটা শান্ত একটু। বাবা আবারও কেসের ফাইলে মন দেয়, আমাকে ডিকটেট করতে থাকে, আমি লিখতে থাকি।
বিধাতার কাছে লাখো শুকরিয়া আমি বাবার মতো আইনের পেশায় ঢুকি নাই। এইসব জিনিস ডেইলি ডেইলি ফেস করার চাইতে ফ্লুইড ডাইনামিক্স নিয়ে পড়ে থাকা বহুগুণে ভালো।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন