বিফোর ইট স্টার্টস রেইনিং, এগেইন
জিইসি মোড়ে আসার কথা ছিল না, তবু আসতে হলো। আকাশের অবস্থা ভালো না, যেকোনো সময় ভেঙ্গে পড়তে পারে মাথার উপর। সাথে ছাতা, রেইনকোট, পলিথিন কিছুই নেই। বাসায় একটাই ছাতা, সেটা আবার আব্বা কাঁচা বাজারে নিয়ে গিয়েছে। এই সন্ধ্যায়, আকাশে ঝড়ের আশঙ্কা নিয়ে, সপ্তাহের একেবারে মাঝামাঝিতে কাঁচা বাজারে কেন যেতে হলো সেটা ঠিক বুঝলাম না। আব্বা বিশেষ কিছু বলেও যাননি।
পাশে দাঁড়িয়ে ভাইয়া মালবোরো এডভান্সে কড়া এক টান দিল, দিয়েই উপরে তাকিয়ে বলল, 'এই বৃষ্টি না হইতে হইতে যে অবস্থা দাড়াইছে, আজকে একটা ফাটাফাটি সিউর হবে।'
বিরক্ত হয়ে বললাম, 'তোমার লোকে কই, আসে না ক্যান?'
মুখ থেকে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল, 'কইলো তো সাতটার আগেই চলে আসবে। দাড়া কল দেই। তুই আরেক কাপ চা খা।' এরপর বলল প্যান্টের পকেট থেকে ফোন বের করতে করতে, 'ওসমানকে কয়টার দিকে বলছিলি আসতে? এইখানে আসবে না?'
'ওসমানকে তো না করে দিছিলাম পরে। তুমি এই কাজে আমাকে বের করবা বুঝলে তো সেইভাবেই কথা বলতাম।'
'এখন কল দে প্যারা কিসের?' ফোন কানে লাগিয়ে ভাইয়া সিগারেটের বাট ছুঁড়ে ফেলতে ফেলতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, 'ওর বাসা তো সিমেট্রি রোডে, তাই না? কতক্ষণ আর লাগবে আসতে।'
'সেটা আমি আসার পথেই টেক্সট করে দিছি।'
'হ্যালো, হ্যাঁ মুরাদ ভাই, কই আপনে...'
আরেক দিকে মুখ ফিরিয়ে কথা বলা শুরু করে দিল ভাইয়া। আজকে তার নাইট ডিউটি ফ্যাক্টরিতে। ফ্যাক্টরির নিজেস্ব পোশাক আছে, ভাইয়া সেটাই পড়ে আছে; হালকা ছাই রঙের শার্ট ও প্যান্ট, পায়ে পুরানো সাদা টেনিস জুতা। সিমেন্টের ফ্যাক্টরিতে ডেপুটি ইঞ্জিনিয়ারের চাকরির পাশাপাশি সে একটা সাইড বিজনেস চালায়। সেই বিজনেসেরই একটা ডেলিভারি আমাকে নিয়ে যেতে হবে বাসায়। যতটুকু জানি ছোট হলেও ব্যবসা ভালোই চলছে। আজকে রাতে ভাইয়ার হঠাৎ নাইট ডিউটি না পড়লে এইখানে আসতে হতো না।
অবশ্য বের আজকে কালকে হতেই হতো। ওসমান গত সাত-আট দিন ধরে জ্বালিয়ে মারছে। দেখা করতেই হবে নাকি। জিজ্ঞেস করেছিলাম কাহিনী কি। বলল, সাক্ষাতে বলবে। এমন কী আর্জেন্ট কাজ যে দেখা করতেই হবে, বুঝলাম না। গলা শুনে অবশ্য বুঝেছিলাম যে গণ্ডগোল কিছু একটা হয়েছে, কিন্তু গণ্ডগোলটা আসলে কী তা কিছুতেই ঠাহর করতে পারলাম না। এমনটা আসলে হবার কথা না। গত ডিসেম্বরে চাকরিতে ঢুকেছে সে এসিআই গ্রুপে, এসিসটেন্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে। ভালো বেতন, আমার থেকে তো প্রায় ডাবল; এমনটা সচরাচর দেয়া হয় না। তাছাড়া পরের মাসে এনগেজমেন্ট, এই বছরের শেষে বিয়ে। যার সাথে বিয়ে, তার সাথে প্রায় তিন বছরের উপরে সম্পর্ক; যেমন-তেমন সম্পর্ক না, একেবারে লাভ বার্ডস। ওর মা-বাবা সুস্থ আছে, আংকেলের ব্যবসা তো খুবই ভালো চলছে; ফ্যামিলিতে ওসমানের তেমন কিছুই কন্ট্রিবিউট করতে হয় না। অতএব, যতদূর জানি, সব, একদম সব চলছে ঠিকঠাক। অন্তত চলার কথা; কিন্তু আসল কথা হলো, চলছে না; কোথাও কোনো একটা ঝামেলা বেঁধেছে।
ওসমান আমার ক্লাস ফাইভের বন্ধু। তখন থেকে শুরু করে একসাথে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস দিয়েছি একই জায়গা থেকে, যদিও সে অন্য ডিপার্টমেন্টের। এমন ভাবার কিছু নেই যে ওসমান আর আমি গলায় গলায় বন্ধু। শুরু থেকেই ওর আর আমার সার্কেল পুরো আলাদা। তবুও এক ধরনের সম্পর্ক আমাদের মধ্যে সবসময় ছিল আর সেটা প্রায় সময়ই ছিল একমুখী। অর্থাৎ, সে প্রতিবার আমার কাছে আসতো এবং দুনিয়ার সব সমস্যা নিয়ে আলাপ করতো; অন্য কিছু নিয়ে না কখনো। আমিও মন দিয়ে শুনতাম। মাঝে মাঝে বিরক্ত হতাম, কিন্তু না বলতাম না। আমার সাথে এমন এমন কিছু সে শেয়ার করতো যা ও কখনোই তার নিজের সার্কেলের সাথে শেয়ার করতো না। খুবই গোপন ছিল কথাগুলো। যেমন, কলেজে থাকতে এক বিকেলে আমাকে ডেকে সে বলে যে, তার মা নাকি পরকীয়া করছে তারই দূর সম্পর্কের কোনো চাচার সাথে। শুনে আমার চোখ কপালে উঠে যায়, ছেলে বলে কি! মানে একটা ছেলে নিজের মায়ের ব্যাপারে এমন কঠিন কথা এমন একজনের কাছে করলো যার সাথে তার তেমন কোনো উঠাবসা নেই। এমনটা মুরাকামির গল্প-উপন্যাসে ঘটে, বাস্তবে ঘটে না। যাইহোক, পরে জানা যায় ঘটনা অন্য, ওসমানই আমাকে বিস্তারিত বলে নিশ্চিত করে। অবশ্য প্রকৃত ঘটনা এর চাইতেও কুৎসিত।
অনেকের মনে হতে পারে, ছেলেটা আমার কাছে এসে এমন সব কথা বলে, প্রায়ই, তবু আমাদের মধ্যে সেই অর্থে বন্ধুত্ব হলো না কেন? কারণ, যেটা শুরুতে বলেছিলাম, আমাদের সম্পর্কটা একমুখী। সে এসে সবকিছু খুলে বলে আমাকে, কিন্তু আমি তো বলি না কিছু, কেবল শুনে যাই। যেকোনো সম্পর্কের জন্য ব্যাপারটা দুই দিক থেকে আসা লাগে, নইলে ঠিক জমে না। বেশিরভাগ সময় তো এমন অবস্থায় সম্পর্কই টিক না। তবু আমাদেরটা কেমন করে যেন টিকে গেল। এর পুরো কৃতিত্ব ওসমানের। সে প্রতিবার আমার কাছে না এলে ওর কাছে যাওয়ার মতো এখনো তেমন প্রয়োজন আমি অনুভব করিনি।
'কি খবর ফুয়াদ, কতক্ষণ দাঁড়ায় আছো? আরে এটা তোমার ছোটভাই না?'
আমাদের সামনে রিকশা থেকে নামতে নামতে মোটামতো এক লোক ভাইয়াকে উদ্দেশ্য করে কথাটি বলল। লোকটির পোশাকও ঠিক একই, ভাইয়ার মতো। বয়সে খুব সম্ভবত সিনিয়র। পজিশনেও। লোকটিকে ঠিক চিনতে না পারলেও লোকটি আমাকে কেমন করে চিনলো বুঝলাম না, 'নাকি একইরকম চেহারা দেখে আন্দাজ করলো?'
'বস কি অবস্থা আপনার? আমি তো ভাবলাম আরও আগে আসবেন।' ভাইয়া বলল মুখভর্তি হাসি নিয়ে।
'আরে আসতাম, শেষ মুহূর্তে বাসায় একটা ভেজালে পড়ে গেছিলাম। আর কইয়ো না। এখন তো সংসার সেইভাবে শুরু করো নাই মিয়া, শুরু করলেই বুঝবা। সাথে বাচ্চা থাকলে তো কথাই নাই।' লোকটি কথাগুলো রিকশাওয়ালাকে ভাড়া দিতে দিতে খুব ন্যাচারালি বলল।
'সেটা বস ভুল বলেন নাই। আফরিনের পোস্টিং তো এখন কুমিল্লায়। এই বছরের শেষে গিয়ে চিটাং এ শিফট করবে।...'
'হুম কইছিলা মে বি। দেখো, শুরু করো। কাউন্সিলিং লাগলে আইসো আমার কাছে, ফ্রিতে দিয়ে দিবো। হা হা হা। বাই দা ওয়ে তুমি ফাহাদ না? ফুয়াদের ছোটভাই না তুমি?'
আমার দিকে ঘুরে কথাগুলো বলল এবার। ব্যাপার কি, নামও দেখি জানে। বললাম, 'জ্বী। ভালো আছেন?'
'হ্যাঁ হ্যাঁ সেটা আছি। কি খবর তোমার বলো। তোমার ভাইয়ের বিয়েতে তো দেখা হইছিল, ভুইলা গেলা নাকি?'
'না মানে ঠিক...'
ভাইয়া আমাকে এই পরিস্থিতি থেকে বাঁচালো। বলল, 'আরে এটা পার্থদা, আমাদের মেইনটেইনেন্স হেড, বিয়েতে আসছিল আমার। বলেছিলাম না খুবই ফ্রেন্ডলি, একেবারে ভাই-ব্রাদার। এর উপর আবার বিসিএস অ্যাডমিন হয়ে গেছে। সামনের মাস থেকে জয়েন করবে। তাই না পার্থদা?'
'হুম ওই আরকি।'
চিনেছি এমন ভান করে বললাম, 'জ্বী আমি চিনতে পেরেছি আপনাকে, বিয়েতে দেখা হয়েছিল। ম্যাডামকে নিয়ে এসেছিলেন ভাইয়ার বিয়েতে।'
'না তো। তখন ও তো ছিল বাপের বাড়ি।'
'অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম পুরাই। ব্যাটা আমার সাথে এমন করছে কেন?'
পার্থদা খুব সম্ভবত আমার এই অস্বস্তি ধরতে পারলেন। হেঁসে বললেন, 'আরে তুমি দেখি নার্ভাস হইয়া গেলা। হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি বউ নিয়েই আসছিলাম। একটু মজা করলাম আরকি, কিছু মনে কইরো না।'
এই বলে তিনি পেছনের টঙ্গের দোকানদারকে একটা লাল বেনসন দিতে বলে আমার দিকে আবার ঘুরলেন।
'তো কোথায় আছো এখন? নাকি বিজনেস-টিজনেস করতেছো কিছু? এখন তো তোমাদের বয়সীরা খালি স্টার্টআপের চিন্তা করে। ব্যাপারটা খারাপ না অবশ্য।'
'জ্বী না, আমি চাকরিই করছি। হক গুপে ঢুকেছি রিসেন্টলি।'
'ওহ নাইস। ভালো। কতদিন হলো জয়েন করলা?' লাল বেনসন ধরাতে ধরাতে জিজ্ঞেস করলেন।
'বেশিদিন না। দুই মাস এখনো হয় নি।'
এর মধ্যে খেয়াল করলাম, যে রিকশাওয়ালা পার্থদাকে এখানে নিয়ে এলো, সে পার্থদার পাশে দাঁড়িয়েই একই ভঙ্গিতে সিগারেট টানছে। একটু আগে একটা শুকনো কেক চাবাচ্ছিল। বিড়ি সিগারেট এমন এক জিনিস, সকলকে এক কাতারে নিয়ে আসে। হয়তো ব্রান্ড আলাদা, দামও। কিন্তু বিড়ি-সিগারেট তো বিড়ি-সিগারেটই; দিন শেষে ওই তামাক, ওই নিকোটিন। পার্থদা লাল বেনসন টেনে যে সুখ পাচ্ছে, পাশে দাঁড়িয়ে থেকে স্টার টানতে থাকা রিকশাওয়ালা মামাও একই সুখ পাচ্ছে। বেশ কমিউনিস্ট কমিউনিস্ট এক দৃশ্য। ভালোই লাগছে দেখতে।
'তোমার মুরাদ ভাই কই?' ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করি। এখনো কপাল ভালো বৃষ্টি নামে নাই। কিন্তু যেকোনো সময়ই নামবে। আর নামলে এই টঙ্গের ভাঙ্গা টিনের ছায়ায় নিশ্চয়ই কাকভেজা হতে হবে। অথচ মিস্টার মুরাদের খবর নেই। অফিসের গাড়িরও খবর নেই। এর মধ্যে চলে আসার কথা। পার্থদা গাড়ির হদিস না পেয়ে কল করলেন। যা জানতে পারলেন তা হলো, রাস্তায় প্রচুর প্রচুর জ্যাম। এক জ্যামে পয়তাল্লিশ মিনিটের মতো আটকে ছিল গাড়ি, এখন পড়েছে আরেক জ্যামে। তাই কখন ছাড়া পাবে কেউ বলতে পারছে না, ফলে এরা দুইজন কথা বলছে বাস বা অন্য কোনোভাবে যাওয়া যায় কিনা।
'বইলো না আর, আমার গাড়িটা গ্যারাজে যে দিছি, এখনো ঠিক হয় নাই। কি যে যন্ত্রণা বলার না। এইসব যন্ত্রণা ভালো লাগে না দেখে শোরুম থেকে কিনলাম। বালের লাভ হইলো।' এই বলে তিনি আরেকটা সিগারেট ধরাতে যাবেন, তখন পাশের মসজিদ থেকে আজানের শব্দ কানে ভেসে এলো। এশার ওয়াক্ত হয়েছে। পার্থদা বেনসন আর ধরালেন না।
'চলো নামাজটা পড়ে আসি। গাড়ি আসতে দেরি আছে যা বুঝলাম।' এই বলে তিনি মসজিদের দিকে হাটা দিলেন। পেছনে পেছনে ভাইয়াও দিল। আমি একটু থতমত খেয়ে গেলাম। ভাইয়া সেটা বুঝলো। আমার কানে ফিসফিস করে বললো, 'কায়সার আহমেদ পার্থ।'
'তাইলে পার্থদা বলো ক্যান?'
'পরে বলবো নে তোকে। এখন চল'
যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম, মসজিদ সেখান থেকে প্রায় মিনিট পাঁচেক হাটা পথ। ওজু করে কাতারে দাঁড়াতেই দেখি আরেক কাণ্ড। ঐযে রিকশাওয়ালা, টঙ্গে পার্থদার সাথে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছিল, আমার পাশে এসে দাঁড়ালো। আর ওর পাশেই পার্থদা। সিগারেট, নামাজ, দুটাই খুবই কমিউনিস্ট কমিউনিস্ট ব্যাপার দেখি। সবাইকে আসলেই এক কাতারে নিয়ে আসে। ইমাম আল্লাহু আকবার বললো, তবুও আমার মাথায় সাম্যের চিন্তাটা ঘুরতে থাকলো। গরীব, বড়লোক, মানে বুর্জোয়া ও প্রোলেটারিয়েট, এই দুই ক্লাস বলে আসলেই কিছু আছে? গরীবরা কি বুঝে যে তারা গরীব, তাদের কষ্ট আছে? নাকি তাদের কষ্টটা আমরা আরোপ করি? এক জায়গায় ভাড়া পঞ্চাশের বদলে আশি টাকা পেলে একজন "প্রোলেটারিয়েট" এর যে আনন্দ হয়, সেই একই আনন্দ এসিরুমে বসে চা পান করতে করতে পাছা ঘামতে থাকা ব্যাংকের "বুর্জোয়া" ম্যানেজারেরও কি হয়? বুর্জোয়া ও প্রোলেটারিয়েট, এই দুই শ্রেণী কিসের ভিত্তিতে আসলে ভাগ করা উচিত, অর্থনীতি না আনন্দ? অর্থ কি আনন্দের প্রধান উপকরণ? যদি হয় তবে বড় বড় পীর-আউলিয়া থেকে শুরু করে মুনিঋষি দার্শনিক পর্যন্ত প্লেজারকে বিষ আখ্যা দিয়ে এর থেকে দূরে থাকতে কেন বলেছেন?
ভাগ্য ভালো, এইসব চিন্তা, বিশেষ করে নামাজের মধ্যে, কেউ শুনতে পাচ্ছে না; নইলে ধার্মিক, অধার্মিক দুই গ্রুপের থেকেই মার খেতে হতো।
নামাজ শেষ হতে প্রায় দশ মিনিটের মতো লাগলো। আমরা আবার টঙ্গের সামনে চলে এলাম। আসতেই দেখি, বাসে করে মিলিটারি একডেমির একদল ক্যাডেট আমাদের সামনে নেমে পড়লো। ছেলে-মেয়ে সকলের চুলই একইভাবে কাঁটা, শরীরের গঠনও প্রায় কমবেশি একই, মুখে একই ধরনের ক্লান্তি মেশানো রুক্ষতা। হঠাৎ দেখলে জেন্ডার আলাদা করা যায় না। চোখের সামনে জ্যান্ত নারীবাদী এক দৃশ্য। এর আগেও এক দুইবার দেখেছি। দৃশ্যটা খারাপ লাগে না, আবার ভালোও লাগে না। কিন্তু আজকে দেখতে তাদের ভালো লাগছে। খুব সম্ভবত প্রতি মাসে ওদেরকে একাডেমির চারদেয়াল থেকে মুক্ত করে শহরে নিয়ে আসা হয়। নিজেদের বাসে করে আসে, নির্ধারিত সময়ের পর আবার একই বাসে চড়ে ফেরত যায়। ঘণ্টাখানিকের জন্য স্বাধীন প্রাণীর মতো ওরা চারপাশ উড়াউড়ি, ঘুরাঘুরি করে বেড়ায়।
এক ক্যাডেট, একটু পরেই, আমার পাশে এসে দাঁড়ালো। অল্প খেয়াল করতেই কিছু একটা অন্যরকম লাগলো ছেলেটার ব্যাপারে। যেহেতু কিছু করার নেই, আমি তাই একটু অভিনিবেশের সাথে যুবকটির দিকে তাকালাম। কয়েক মিনিটেই রহস্য উদঘাটন করে ফেললাম। সমস্যা তার চোখে। কেমন ভাষাহীন চোখ। এমনটা আগে দেখিনি। কারো না কারো চোখে ভাষা থাকে, সামান্যতম ভাষাও থাকে। মুখে কথা না বললেও চোখ কিছু না বলে অনেক কিছুই উচ্চারণ করে আমাদের সামনে। সেটা মুখের ভাষার চাইতেও স্পষ্ট। কিন্তু অদ্ভুত, এই ছেলের চোখে সেটা নেই। একেবারেই নেই।
টঙ্গের মামাকে এক কাপ চা এবং লাল গোল্ড লিফ দিতে বলে শরীর স্ট্রেচ করলো সে। এরপর আশেপাশে একটু তাকিয়ে কি মনে করে আমার কাছে এলো।
'ভাই, কয়টা বাজে একটু বলবেন?'
আমি বললাম।
'ওহ।'
"ওহ" বলার সাথে সাথেই দেখলাম, ওর চোখে ভাষা খেলা করছে। এলোমেলো যদিও, তবুও খেলা করছে। আমি কৌতূহল বোধ করলাম। আর আমার কৌতূহল মেটাতেই যেন সে সাথে সাথেই বললো, 'আপনার ফোন দিয়ে একটা কল করা যাবে কি? দুই মিনিটও লাগবে না।'
'হ্যাঁ সিউর। বলে পকেট থেকে ফোনটা বের করে ছেলেটার হাতে দিলাম।'
কেমন এলোমেলোভাবে সে নাম্বার টাইপ করলো, একইরকম এলোমেলোভাবেই কানে ফোনটা ধরলো। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে তার চোখে ধীরে ধীরে পাহাড়ি উদ্দাম ঢলের মতো ভাষার আগমন দেখতে থাকলাম। এটা ছিল বিস্ময়কর, অন্তত আমার জন্য। চোখের সামনে যেন কোনো প্রাণের জন্ম দেখছি।
'হ্যালো।' ছেলেটা বলল অপরপ্রান্তের একজনকে।
'হ্যাঁ একটু আগে নামলাম।' সে বলে চলল। অপরপাশের কথা শুনার অবস্থা নেই, চুপচাপ ছেলেটার কথাই শুনে গেলাম।
'তুমি আসবা কখন?... কি, কেন কি সমস্যা? আরে বৃষ্টি পড়বে না তো।... তোমার সাথে দেখা হয় না ছয়টা মাস।... কেন টাইম হয় না কখনো?... প্রতিবারই এমনটা হয়?'
ছেলে ফোনটা রেখে দিল। আর রাখার সাথে সাথে ধুপ করে তার চোখ দুটা পাথরে পরিণত হলো। এমন পাথর, এক গ্যালন পানি ঢাললেও শুষে নেবে সবটুকু, একটুও ভিজবে না।
ফোনটা ফিরিয়ে দিয়ে আমাকে 'থ্যাঙ্কস' বলে চায়ের কাপ আর সিগারেট নিয়ে একটু দূরে চলে গেল রুক্ষ চেহারার পাথর চোখের ক্যাডেটটি, একটু অন্ধকারে, চোখের আড়ালে।
বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা লাগলো না এরপর। ভাইয়ার পার্সেল নিয়ে মুরাদ নামের লোকটি চলে এলো। এর সাথে সাথেই ভাইয়ার গাড়িও চলে এলো। আমি কিছুক্ষণ পার্সেল হাতে ওইখানে দাঁড়িয়ে এক কাপ চা খেলাম। খেতে খেতে ওসমানকে কল করে বের হতে বললাম। ওসমান জানতে চাইলো কই বসতে চাই। বললাম যে, এটা যেন ও ঠিক করে, কারণ কাজ তার, আমার না।
'তুই রিও কফিশপে চলে আয় তাইলে। প্যারা হবে না তো?'
'না। আমি আসতেছি।'
'তুই লাগলে বাসার সামনে আয়, আমরা একসাথে গেলাম না হয়।'
'না প্যারা নাই, আমি আসছি। তুই আয় তাড়াতাড়ি। বাসায় কাজ আছে একটা।'
একটা রিকশায় উঠে জিইসি মোড় থেকে খুলসীর দিকে যাওয়া শুরু করলাম। প্রচুর বাতাস বইছে। ভরাট করা ভেজা এক বাতাস। আকাশ বেশ অনেকটা লাল হয়ে আসছে। সন্ধায় যখন এইখানে এসেছিলাম, এতোটা লাল ছিল না। লাগছে, মেঘের ওপাশে আগুন পুড়ে যাচ্ছে রাতের গোটা আকাশ।
সোজা পথ, একটু যেতেই রিকশা আটকে গেল। ফালতু একটা জ্যাম বেঁধেছে। এই ধরনের জ্যাম লাগতো না যদি না আমাদের মানুষের মধ্যে সামান্য সিভিক সেন্স থাকতো। যাইহোক, বিরক্ত হয়ে বসে একপাশে তাকাতেই চোখে পড়লো রাস্তার এক ধারে ফুটপাতের উপর ছোট চুলের এক মেয়ে ক্যাডেট দাঁড়িয়ে কার জন্য যেন অপেক্ষা করছে। তিরিশ সেকেন্ড যেতে না যেতে দেখি এক ছেলে, মেরুন রঙের পাঞ্জাবি পড়ে, হাতে ছোট্ট একটা গোলাপ ফুলের তোড়া নিয়ে পেছন থেকে সারপ্রাইজ করলো মেয়েটিকে। মেয়েটি চমকে উঠলো। আর চমক কাটতে না কাটতে ছেলেটা মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরলো, মাত্র কয়েক সেকেন্ড, তারপর ছেঁড়ে দিল। ঠাঁসা রাস্তায় এই বেশি। ফুলের তোড়া থেকে একটা ফুল হয়তো গুঁজে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু মাথাভর্তি চুল কই! আচ্ছা, ক্যাডেটদের মনও কি এরকম ফুল পেলে আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে? নাকি ট্রেনিং, দৌড়ঝাঁপের মারপ্যাচে কোনো কিছুই আর ভালো লাগে না? প্রশ্নটা করতে ইচ্ছা করলো, কিন্তু জানি করা হবে না।
বাস থেকে নামার সময়, এমনকি একটু আগেও ক্যাডেটটার চোখে-মুখে ছিল ক্লান্তি মেশানো রুক্ষতা। জাস্ট কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে পুরো দৃশ্যপট যেন পাল্টে গেলো। এখন দুইজনের চোখ-মুখ উজ্জ্বল, আতশবাজি ফাটা নতুন ইংরেজি বছরের আকাশের মতো। কদর্য এই দুনিয়া থেকে পৃথক এখন তারা, তেমনই থাকবে এই কয়েক ঘণ্টা। আমি চেয়ে চেয়ে ওদের দুনিয়ায় তাকিয়ে রইলাম। দেখলাম ছেলেটা পাঞ্জাবির পকেট থেকে এক জোড়া কানের দুল বের করে মেয়েটিকে পড়িয়ে দিতে লাগলো। বেশ যে কষ্ট হচ্ছে পড়িয়ে দিতে সেটা এই দূরে রিকশায় বসেই বুঝতে পারলাম। কিন্তু আফসোস, পুরো দুই কানে দুল পড়া দেখে যেতে পারলাম না, রিকশা চলা শুরু করলো; আর সেই সাথে আমার ওই পাথর চোখের ছেলেটার কথা মনে পড়ে গেল। রিকশায় উঠার পর থেকে খেয়াল করিনি আশেপাশে।
রিও এর সামনে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ওসমান চলে এলো। আমার দিকে তাকিয়ে হেঁসে হাই বললেও পুরো শরীরে ভালো রকমের আড়ষ্ট একটা ভাব। স্পষ্টই বুঝা যাচ্ছে সেটা।
গেট থেকে ভেতরে ঢুকতে যাবো, তখনই, কোনো ভণিতা ছাড়া, আচমকা, ওসমান বললো, 'মাইশা চিটেড অন মি, উইথ শাওন।'
এরপর বাতি নেভার মতো চুপ করে গেল। আমরা দুইজন ভেতরে প্রবেশ করলাম; নীরবে। আর তখন তখনই, কোনো প্রকার আওয়াজ, উত্তেজনা ছাড়া, অবাক করে দিয়, বহুদিনের প্রতীক্ষিত বকেয়া ঠাণ্ডা বৃষ্টি ঝড়ের রূপে ঝড়ে পড়লো আমাদের কফিশপের ঠিক বাইরেই।
_______________
মীরেরচক, রাজশাহী
১৫/০৫/২০২৪ ইং।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন