লোভে পাপ, পাপেই আনন্দ

 


মানুষের লোভকে যখন থেকে কমার্শিয়ালাইজড করা শুরু হয়েছে, তখন থেকে আমরা নিজেরাই নিজেদের বন্দী করা শুরু করেছি, শুরু করেছি অত্যাচার করা, জুলুম করা নিজেদের উপর। খাবার আছে, না আমার ফাস্টফুড দরকার; থাকার জায়গা আছে, না আমার নিজের একটা বাসা দরকার; চলাচলের জন্য বাস-ট্রেন আছে, না আমার প্রাইভেট কার দরকার; পড়ার মতো জামাকাপড় আছে, না আমার ব্র্যান্ড দরকার। এইখানেই শেষ নয়। যেমন, বার্গার পাচ্ছি, না আমার গোল্ড ফয়েলে র‍্যাপ করা বার্গার চাই; নাখালপাড়ায় বাসা কিনেছি; না আমার এখন ধানমণ্ডিতে বাসা চাই; টয়োটা কিনেছি, না আমার এখন অউডি চাই; ব্র্যান্ড পেয়েছি, না আমার এখন লিমিটেড এডিশন দরকার। বুঝা যাচ্ছে এইটার কোনো শেষ নেই।

আমরা ভুলে যাচ্ছি এবং একইসাথে আমাদের ভুলিয়ে দেয়া হচ্ছে যে, আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে, প্রয়োজনের অতিরিক্ত যেকোনো কিছুই বিষ। উল্টো সেই বিষ কতো রংচং মাখিয়ে আমাদের সামনে রেখে ভেল্কি দেখানো হচ্ছে। আর আমরাও তা দেখে নেচে চলছি। দেখেন, লোভ এমনিতে খারাপ বিষয় না। মানুষের রক্তের ভেতর, মজ্জার ভেতর লোভের অস্তিত্ব রয়েছে, একদম আদিম যুগ থেকেই রয়েছে। ওই সময়ে টিকে থাকার জন্য লোভের প্রয়োজন ছিল। যেমন, প্রয়োজনের অতিরিক্ত খেলে আমাদের শরীরে চর্বি জমে, জমতেই থাকে। কিন্তু কেন জমে? জমে যেন আমাদের শরীর খাদ্যের অভাবে সেই চর্বি ভেঙ্গে শক্তি পায়। আদিম যুগে এমনই ছিল, হয়তো আজকে বড় কোনো শিকার হয়েছে, ভরপুর খাওয়াদাওয়া, অথচ দেখা যাবে, পরেই দুই-তিন দিন কোনো খাবার নেই, লতাপাতা খেয়ে থাকতে হবে। আর সেই সময় তো ফ্রিজ নেই, ফলে শরীর সেই অতিরিক্ত খাবার জমিয়ে রাখে পরে। ফলে ইন-জেনারেল আমরা বেশি খাবার পেলে লোভে পড়ে বেশি খাই। এই লোভ খারাপ না, বরং বেঁচে থাকার জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কাহিনী হচ্ছে, এই সময়ে এসে আমাদের সেই লোভের প্রয়োজন নেই, বেঁচে থাকার জন্য অতিরিক্ত খাওয়ার দরকার নেই। সমস্যা হলো, আমরা যে আমাদের আদিম ইন্সটিংক্ট ভুলতে পারি না, নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। 

আর এই লোভ খাদ্যের থেকে ডালপালা মেলে চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে। আমরা প্রয়োজনের অতিরিক্ত জিনিস বগলদাবা করতে তাই দুই সেকেন্ডও ভাবি না। হ্যাঁ, প্রয়োজনের অতিরিক্ত জিনিস রেখে দেয়া খারাপ না, বিপদে কাজে দেয় কিন্তু আজকের যুগে যা হচ্ছে সেটাকে কোনোভাবে স্বাভাবিক বলা যায়? না যায় না। পুরা জিনিসই ঘটছে লাভের জন্য, পুঁজির জন্য। বুদ্ধিমান পুঁজিপতিরা খুব ভালো মতো জানে কীভাবে মানুষের এই আদিম ইন্সটিংক্ট অর্থাৎ লোভকে কেন্দ্র করে ব্যবসা সাজানো যায়, কীভাবে সাধারণ মানুষকে ম্যানিপুলেট করে আরেকটু বেশি কিছু কিনতে বাধ্য করা যায়। এইজন্য সব কোম্পানিতে আমরা বড় বড় মার্কেটিং টিম দেখি, যাদের প্রধান কাজ হলো আমাদের সামনে আমাদের নতুন নতুন চাহিদা পয়দা করা। যেইসব চাহিদার কোনোই মানে নেই, প্রয়োজন নেই, এমনকি এদের চাহিদা বলাই ভুল। পুঁজিপতিরা যে কতো কতো টাকা এই মার্কেটিং-এ ঢালে শুনলে অবাক লাগে। আর এটা কাজেও দেয়। মানুষ চোখের ক্ষুধায় কিনেই ফেলে, পরে বুঝতে পারে, এই জিনিসের কোনোই প্রয়োজন নেই।

অথচ এই কাজ পুঁজিপতিরা কতো সহজেই করতে পারছে, ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে লিবারালিজমকে। মানুষের স্বাধীনভাবে (?) যা ইচ্ছা করার অধিকার আছে কাউকে ক্ষতি না করে, এমনিতে এটা ভালো শুনালেও এর মধ্যে লুপহোল খুঁজে পুঁজিপতিরা কি সহজে মানুষকে ম্যানিপুলেট করেছে। এই ম্যানিপুলেশনের গল্প আমরা সেমেটিক টেক্সটে আদম-হাওয়ার গল্পে কিন্তু দেখতে পাই, যেখানে শয়তান তাদের প্ররোচিত করে নিষিদ্ধ ফল খেতে। ফলাফল কি দাঁড়ায়? স্বর্গ থেকে বিচ্যুতি। আমরা কি এই গল্প থেকে শিক্ষা নিয়েছি? আমরা কি শয়তানকে চিনতে পেরেছি? নিষিদ্ধ ফল খাওয়া থেকে নিজেদের বিরত রাখতে পেরেছি? না পারিনি, ফলে আমাদের স্বর্গ নরকে পরিণত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আমরা বোকারা সেটাও বুঝতে পারছি না। আমরা বুঝতে পারছি না, সব সময় জীবনে প্রথম হওয়াটা ইমপরটেন্ট না, কখনো আমাদের দ্বিতীয়, তৃতীয় কিংবা চতুর্থ হতে হবে। ইরানি পরিচালক মাজিদ মাজিদি তাঁর জগতখ্যটা "চিলড্রেন অব হেভেন" ফিল্মে এই বিষয়টা কি সুন্দর করেই না দেখিয়েছেন! সেইখানে ছোটবোনের জুতা হারায় ফেলে বড়ভাই, এরপর দুইজন এক জোড়া জুতা দিয়ে স্কুলে যাওয়া আসা করে, কারণ দ্বিতীয় জোড়া জুতা তাদের নেই। ফিল্মের শেষে আমরা দেখি বড়ভাই স্কুলে ম্যারাথনে অংশ নেয়, কারণ সেইখানের তৃতীয় পুরস্কার ছিল এক জোড়া জুতা। সেই ম্যারাথনে বড় ভাই এমনভাবে দৌড়ায় যে সে তৃতীয় হতে পারে না, প্রথম হয়ে যায়। প্রথম হওয়ার দুঃখে সে কাঁদতে থাকে, অঝরে কাঁদতে থাকে কারণ সে জিতেও হেরে গেছে। দুঃখের বিষয় হলো, ওইটুকু বাচ্চা নিজের প্রয়োজনটুকু বুঝলেও আমরা বুঝি না, বুঝি না যে সব সময় প্রথম হওয়া মানে জিতে যাওয়া নয়, হেরে যাওয়া। আর আমরা বোকারা তাই হেরে যাচ্ছি, প্রতিদিন। 

 যেইদিন এই লোভ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারবো ওইদিন আমাদের আধুনিক জীবনের সকল সমস্যা প্রায় শেষ হয়ে আসবে। কিন্তু সেটা হবার নয়, কারণ লোভ এমন এক জিনিস যা আমাদের মজ্জার ভেতর আছে। এর থেকে হয়তো মুক্তি নেই। আর মুক্তি হলেও হয়তো নতুন কোনো আরো জটিল সমস্যা তৈরি হবে। তখন কি হবে আমাদের?

~

০৪-০৬-২০২৪

মীরেরচক, রাজশাহী।     

The painting: "The Temptation of Saint Anthony" by Salvador Dalí (1946)

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ