বিক্ষোভের রাতগুলোয় কবিতা
কবিতা আমার বিরাট বড় এক আশ্রয়। কোনো এক অজানা কারণে এই আশ্রয় নিয়ে আমি খুব কম কথা বলেছি। ফেসবুকে প্রায় কিছুই লিখিনি বলতে গেলে, এমনকি আশেপাশের মানুষ খুব যে জানে তেমনও না। কিন্তু দিনশেষে, ক্লান্ত হয়ে আমার কবিতার কাছেই ফিরে যেতে হয়। কবিতাই আমার ক্ষতগুলোর উপর গাঢ় মমতায় হাত বুলিয়ে দেয়।
কি প্রসঙ্গে এই কথাগুলো বললাম, একটু বলি তাহলে।
প্রায় এক মাসের উপর এক মারাত্মক অস্থির সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি আমরা সকলে। কতো কতো রাত ঠিক মত ঘুম আসতে চায় না। রাতের অন্ধকার চেপে ধরে আমাকে; মনে হয়, বুঝি এই অন্ধকার থেকে আর বের হতে পারবো না। আমার নিঃশ্বাস থেমে আসে ঢাকার ট্রাফিক জ্যামের মতো। আর এমনই ভয়াল এক সময়ে আমার পাশে কবিতা এসে দাঁড়ায়। জীবনানন্দের কবিতাসমগ্র আমি হাতে নেই। তাঁর মতো এত নির্জন ও এত দুঃখী এক কবির কবিতা পাঠ করা এমন সময় উচিত না জেনেও পড়ি, পড়তে থাকি, বিষে বিষক্ষয় হবে এই ভেবে। পড়ি জীবনানন্দের "সুচেতনা" কবিতা, যেখানে তিনি লিখেছেন:
পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন;
মানুষ তবুও ঋণী পৃথিবীরই কাছে।
লাইন দুইটি পড়ার সাথে সাথে মনে হয় যেন অন্ধকারের মাঝেও কিছু কিছু দেখতে পাচ্ছি, ঠিক মতো নিঃশ্বাস নিতে পারছি। এরপর জীবনানন্দ পড়া বাদ দেই। কারণ বেশিক্ষণ পড়লে যেকোনো সময় বিষন্নতা এবং মৃত্যুর প্রতি এক ধরনের তীব্র মমতা আমার ভেতর বাসা বাঁধতে পারে। কারণ জীবনানন্দ দাশের মতে, আমার এই অতি প্রিয় কবির মতে, মৃত্যুর মাঝেই যেন সব শান্তি নিহিত। তিনি লিখেছেন: 'কোথায় রয়েছে মৃত্যু? কোনদিকে? খুঁজি আমি তারে।' কারণ হিসেবে বলছেন:
যেই ঘুম ভাঙে নাকো কোনোদিন ঘুমাতে ঘুমাতে
সবচেয়ে সুখ আর সবচেয়ে শান্তি আছে তাতে।
কিংবা:
অথবা হয়নি ঘুম বহুকাল
লাশকাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার
ফলে, বেশিক্ষণ জীবনানন্দে পড়ে থাকা বিপজ্জনক। চলে যাই আমার প্রিয়তম কবিদের একজন, রবার্ট ফ্রস্টের কাছে। মনে পড়ে যায় তিনি এই পৃথিবীকে নিয়ে, পৃথিবীতে তাঁর এই জীবন নিয়ে লিখেছিলেন,
I would have written of me on my stone:
I had a lover's quarrel with the world
তিনি বলছেন, পৃথিবীর সাথে আমার প্রেমিকার মতো এক ঝগড়ার সম্পর্ক ছিল, এইটাই আমি আমার এপিটাফে লিখে রাখতে চাই। অর্থাৎ, প্রেমিকার সাথে এই যে ঝগড়া আমারদের হয়, আমরা জানি, এতে রাগ, ক্রোধ, অভিমান থাকলেও, দিনশেষে এই ঝগড়াটাই তাঁর প্রতি আমাদের ভালোবাসার বহির্প্রকাশ, এই ঝগড়াই বলে দেয় আমাদের মধ্যে ভালোবাসাটা আছে। এই পৃথিবীর সাথে আমাদের সম্পর্কও এমনই। মানুষের এই জীবন নিয়ে, পৃথিবীর সাথে আমাদের এই গভীর সম্পর্ক নিয়ে এর চেয়ে সুন্দর কথা আর কেউ বলেছে? রবার্ট ফ্রস্টের এপিটাফে কিন্তু "I had a lover's quarrel with the ওয়ার্ল্ড" লাইনটি সত্যি সত্যি লেখা আছে।
মজার কথা, জীবন নিয়ে এমন মধুর কথা বলা এই মহান কবি তাঁর আরেক কবিতায় লিখেছেন ঈশ্বরকে উদ্দেশ্য করে:
Forgive, O Lord, my little jokes on thee
And I'll forgive Thy great big one on me
কী তির্যক এক মন্তব্য জীবন সম্পর্কে! বলেছেন, হে ঈশ্বর, তোমাকে নিয়ে একটু-আধটু মশকরা করেছি বলে মাফ করে দিও, আর দিলে তুমি আমার সাথে যে মহা মশকরাটি করেছো সেটা আমি মাফ করে দিবো। চিন্তা করে দেখেন কি সাংঘাতিক কথা। আমাদের এই জীবন, এটা ঈশ্বরের করা নিছক কোনো মশকরা ছাড়া, কৌতুক ছাড়া কিছুই না! ঈশ্বরকে কি আমরা ক্ষমা করতে পারবো? তিনি কি আমাদের ক্ষমা করবেন? কি অদ্ভুত! কি অদ্ভুত!
বাইরে তাকাই আমি। নৈঃশব্দ্য ছাড়া আর কিছুই নেই আশেপাশে। এরই ভেতর বসে বসে আমি এই কসমিক কৌতুকের কথা ভেবে, রাতের এই কৌতুকময় অন্ধকারে, নিজের অজান্তেই ফিক করে হেসে উঠি। আর হেসে উঠতেই ধরে ফেলি কবি খ্রিশ্চিনা রোজেটির কবিতাটি, স্পষ্টভাবে:
I shall not see the shadows,
I shall not feel the rain;
I shall not hear the nightingale
Sing on, as if in pain:
And dreaming through the twilight
That doth not rise nor set,
Haply I may remember,
And haply may forget.
এভাবেই পুরোটা রাত, কবিতা আমার এক নিরাপদ আশ্রয় হয়ে পাশে বসে থাকে, আমারই মতো করে।
~
০৯-০৮-২০২৪
মালিবাগ চৌধুরীপাড়া, ঢাকা।
Painting: "The Massacre at Chios" by Eugène Delacroix (1824)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন