"বাংলায় ইসলাম: সহজিয়া ও রক্ষণশীল ধারা" বইটি নিয়ে কিছু কথা

 


প্রায় এক সপ্তাহ হয়ে গেল "বাংলায় ইসলাম: সহজিয়া ও রক্ষণশীল ধারা" পড়ে শেষ করলাম। এই অতি গুরুত্বপূর্ণ বই নিয়ে লিখবো লিখবো করেও লেখা হচ্ছিল না নানা কারণে। অবশেষে যখন লেখার জন্য বসলাম, মনে হলো আলাদা করে কিছু না লিখে প্রথমে এই বইয়ের একটি অনুচ্ছেদ তুলে ধরা যাক।
 
বইয়ের সপ্তম অধ্যায়ের একদম শেষে গিয়ে স্বকৃত নোমান লিখছেন, "বাংলাদেশের সমাজ আজ যে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে, এই তলানিতে থেকে সমাজটাকে উদ্ধার করার জন্য পশ্চিমের জ্ঞান দিয়ে হবে না। লাঁকা, দেরিদা, ফুকো বা গ্রামসি দিয়েও হবে না। তাঁদের জ্ঞানের ধারক-বাহকদের দিয়ে, যারা বলেন, 'ইংরেজি শিক্ষার চেয়ে মাদ্রাসার শিক্ষকরা মেধাবি', তাদের দিয়েও হবে না। হবে সেসব সহজিয়াপন্থি লোকবুদ্ধিজীবীদের প্রচারিত গানের দ্বারা, গানের মধ্য দিয়ে তাঁদের প্রচারিত দর্শনের দ্বারা। হবে শরিয়ত বয়াতি, রীতা দেওয়ান প্রমুখের মতো সহজিয়া বাঙালি মুসলমানদের দ্বারা। তাঁরাই বর্তমানের আলোকবর্তিকা, তাঁরাই জ্বালিয়ে রেখেছেন জ্ঞানের প্রদীপ। যে কাজটি রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে হওয়ার কথা সেই কাজটি তাঁরা করছেন। তাঁদেরকে অভিবাদন।"
 
অনুচ্ছেদটি পড়া শেষে মনে পড়ে যায় কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের একটা কথা। যতটুকু মনে পড়ছে, তিনি এভাবে বলেছিলেন, এই দেশের কমিউনিস্টদের জ্ঞান থাকলেও কাণ্ডজ্ঞান কম। স্বকৃত নোমান ধরতে পেরেছেন, কেন পশ্চিমা দর্শনের কথা বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলা বুদ্ধিজীবীরা এই দেশের জন-মানুষের থেকে এতোটা বিচ্ছিন্ন। আমি নিজে পশ্চিমা দর্শন পড়া এবং এর দ্বারা প্রভাবিত হওয়া মানুষদের একজন। আমি তাই আরো সূক্ষ্মভাবে ধরতে পারি লেখকের এই ইঙ্গিত। বর্তমান বাংলাদেশকে সামনে রেখে সাহসের সাথে এইসব কথা কম মানুষই বলেছেন বলে জানি। 
 
এটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে, শুধু ওই অতটুকু বলেই তিনি কাজ শেষ করেছেন। তাঁর এই বইয়ে লালন সাঁই, সন্ত কবীর, দাদূ দয়ালদের মতো মনিষীদের কথা উঠে এসেছে প্রাঞ্জল গদ্যে। এই বইয়ে লেখকের নিজের কথা রয়েছে কমই, বেশিভাগই রয়েছে আমাদের ইতিহাসের কথা, বাংলার সমাজে ইসলাম কীভাবে মিশে গিয়ে নিজেকে বিকশিত করেছে এবং সফল হয়েছে সেটার কথা। পাশাপাশি রয়েছে কট্টরপন্থি রক্ষণশীল ইসলাম এবং এদের ধারক-বাহকদের কথাও। অনেকে যারা মাজার ভাঙ্গা নিয়ে উল্লাস করছেন, তাঁদের তো পড়তেই হবে এটি। নিজের পালন করা শুদ্ধ ইসলাম নিয়ে গর্ব এবং অহংকার করা মানুষদেরও এটি অবশ্যপাঠ্য, বিশেষ করে বইয়ের চতুর্থ অধ্যায়, "আত্মপরিচয় সংকট ও ইউটোপিয়ান বিশুদ্ধ ইসলাম"। সর্বোপরি, যারা আমাদের সমাজকে আরেকটু ভালো করে বুঝতে চান, যারা আমাদের আশেপাশের মানুষকে বুঝতে চান, যারা এই দেশের, এমনকি এই উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িকতার একেবারে গোড়ায় যেতে চান, তাঁদের জন্য এই বই হতে পারে এক চমৎকার পাঠ।
 
বলে রাখা ভালো, বইয়ের বিষয়বস্তু নিয়ে ধারণা থাকলেও, এই নিয়ে অল্পবিস্তর পড়াশোনা থাকলেও, কোনো বিশেষজ্ঞ নই আমি। তাই সঠিকভাবে এর সমালোচনা করতে পারছি না বলে দুঃখিত। যারা মনে করেন এই বই আসলে পুরোটাই ফালতু, তাঁদের উচিত হবে কড়া ভাষায়, যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত সামনে এনে এই বইয়ের বিষয়গুলো ধরে ধরে সমালোচনা করা। কিন্তু কেউ সেটা খুব একটা পারবে বলে আমার মনে হয় না। কারণ বইয়ের শেষে ৪০টি সহায়ক গ্রন্থের উল্লেখ ছাড়াও, বইটি পড়লেই যে কেউ বুঝবে যে এটা এক বড় পরিশ্রমের ফসল। স্বকৃত নোমান নিজেও মাদ্রাসায় পড়া লোক। তাঁর পিতাও ছিলেন মাদ্রাসার শিক্ষক। এইসব বাদেও তাঁর বিস্তর পড়াশোনার ব্যাপারে আমি ব্যক্তিগতভাবে জানি।
 
শুনেছিলাম গত বইমেলায় নাকি খুব বিক্রি হয়েছিল এই বই। খুবই আনন্দের কথা। একইসাথে আশার কথাও। বইটি পড়ার ফাঁকেই নোমান ভাইকে অভিনন্দন জানিয়েছিলাম, এখন আবারো জানাই: আপনাকে অভিনন্দন। 
 
শেষে বলতে চাই, যেমনটা বইয়ের ভূমিকার শেষে নোমান ভাই লিখেছিলেন, "সর্বমানবের সম্মিলিত সংগীত উৎসবে মুখর হোক পৃথিবী। সর্বপ্রাণের কল্যাণ হোক।"
 
~
১৭-০৮-২০২৪
মালিবাগ চৌধুরীপাড়া, ঢাকা।

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ